অচিন্ত্য।
করোনার আতঙ্কে খোলাখুলি মনের কথা বলতে একটু সঙ্কোচ হচ্ছে। কারণ, সার্বিক ভাবে চারপাশের মানুষ এখন খারাপ অবস্থায় আছেন। বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে যেখানে দারিদ্র একটা চরম বাস্তব, সেখানে এমন ঘটনার অভিঘাত যে কতটা মারাত্মক হতে পারে, তা বোধহয় সকলেই কমবেশি টের পাচ্ছি। এমন পরিস্থিতিতে নিজের দুঃখের কথা বলে সকলের ভার বাড়াতেও ভয়ও হচ্ছে। আরও আশঙ্কা, এই নিদারুণ সময়ে খোলা মনের সেই কথা অন্যের চোখে যদি দুঃখবিলাস বলে ঠেকে!
ক্রমশ দেখছি অসহিষ্ণুতা, অসন্তোষ, ক্ষোভ চারপাশে কেমন আরও গভীরে শিকড় বিস্তার করে চলেছে। মতপার্থক্য, মূল্যবোধের পার্থক্য, সব থেকে বড় কথা ব্যক্তি বিশেষের যে পার্থক্য, সেই সব ভুলে যে কোনও রকম ভিন্নতার সম্মুখীন হলেই আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ছি আমরা। নিজস্ব সীমানা লঙ্ঘন করে অযথা আঘাত করছি অন্যকে। অদৃশ্য অর্থহীন তুলনার মাপকাঠি সর্বত্র যেন অনুভূত হচ্ছে। কে বেশি ঠিক? কে বেশি সংবেদনশীল? কে বেশি নৈতিক? এমনকি কার বেশি দুঃখ?— সব ওজন করে চুলচেরা বিচার করতে হবে! আর বিচারক সকলেই। জানি না, এমন বিচারবুদ্ধি থেকে নিষ্কৃতির উপায় কী?
আমি এক জন ট্রান্সজেন্ডার। কিন্তু আমি শারীরিক রূপান্তর চাই না। এই সিদ্ধান্তে অতীতে আমায় যে সমস্যাতেই পড়তে হোক না কেন, এখন অন্যদের তুলনায় জীবন অনেক স্থিতিশীল। সম্মানজনক চাকরি আছে, মাথার উপরে নিশ্চিন্ত আশ্রয় আছে, পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে। কাল কী খাব, তা নিয়ে ভাবতে হয় না। সর্বোপরি পাশে এক জন সংবেদনশীল সঙ্গী আছেন, যিনি সব বিষয়ে যত্নশীল।
আরও পড়ুন: চিনার পার্কের হাসপাতালে চিকিৎসকের করোনা মেলায় উদ্বেগে অন্যরা
আরও পড়ুন: মেডিক্যালে প্রসূতির করোনার জেরে একগুচ্ছ নির্দেশিকা স্বাস্থ্য ভবনের
তবু বলব, এই কঠিন পরিস্থিতিতে যখন পাশে থেকে পরস্পরকে সাহস জোগানোর কথা, দায়িত্ব ভাগ করার কথা, তখন নিজের বাড়ি থেকে আমরা দূরে। কারণ, অবশ্যই সামাজিক স্বীকৃতি। দুই পরিবার মেনে নিলেও তাদের পরিধির মধ্যে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মর্যাদা দিতে তারা নারাজ। তাই আমরাও সঙ্গীর বাবা-মায়ের মানসিক অশান্তি না বাড়িয়ে একে অপরের থেকে পৃথক থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার জীবনসঙ্গী আপাতত তাঁর বাবা-মায়ের পাশে থেকে সন্তানের দায়িত্ব পালন করছেন। আর গোটা অ্যাপার্টমেন্ট জুড়ে আমার একলা যাপন।
অন্যান্য এলজিবিটি বন্ধুদের থেকেও মাঝেমধ্যে ফোন পাচ্ছি। করোনা পরিস্থিতিতে তাঁরা এক এক রকম বিপন্নতার মধ্যে আছেন। তাঁদের কেউ কেউ সমাজ এবং পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে পছন্দের মানুষকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলেন। দু’জনে মিলে কম মাইনের চাকরিতে একটি ঘর ভাড়া করে, দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে শান্তিতে থাকতে চেয়েছিলেন। তাঁরা ভেবে কূল পাচ্ছেন না এ বার দু’মাসের ভাড়া বাকি পড়লে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের কী হবে? মাইনে কাটা হলে কী খাবেন? একে অন্যকে হারানোর ভয় তো আছেই। এক জনের কিছু হলে অন্য সঙ্গী কী করবেন? পরিবারকে কী জানাবেন? এক জনকে ছেড়ে অন্য জন যাবেনই বা কোথায়?
কেউ কেউ বলছেন, বাড়ির তুলনায় বাইরের জগৎই তাঁর কাছে বেশি নিরাপদ ছিল। পারিবারিক অশান্তি, শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার এ সব ছেড়ে পালিয়ে দু’দণ্ড শান্তিতে কাটাতেন। এখন সর্বক্ষণ দুর্বিষহ অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে। যাঁরা নিগ্ৰহ সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের কারও কারও পরিবার পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পুলিশে মিথ্যে অভিযোগ করে ফিরিয়ে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।
এ ছাড়া যাঁরা হিজড়ে, প্রাদেশিক অন্য পেশা, যৌন ব্যবসার উপরে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাঁদের অবস্থা নতুন করে বর্ণনার প্রয়োজন বোধহয় নেই।
সব পাঠকের কাছে আবেদন, কোন সমস্যাকে অগ্ৰাধিকার দেওয়া উচিত, এই বিচারের আগে তাঁরা যেন নিজেদের এই পরিস্থিতির মধ্যে রেখে অনুভবের চেষ্টা করেন। তা হলে নিজেরাই হয়তো একে অপরের পাশে থেকে অনেকটা সাহায্য করতে পারব। সে ক্ষেত্রে অন্য পরিকাঠামোর উপরে ভরসা করে বসে থাকতে হবে না। সরকারের কাছেও আবেদন, করোনা-সঙ্কটে কোণঠাসা সামাজিক গোষ্ঠীগুলির প্রতিও থাকুক নজর।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)