চিকিৎসার অপেক্ষায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে মনীষা দাস। সোমবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
জরুরি বিভাগ। তবে চিকিৎসা পেতে হলে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে ‘অপেক্ষা’ এড়ানো কঠিন! তিনটি পৃথক ঘটনায় এমনই অভিযোগ করলেন রোগীর পরিজনেরা।
নাদিয়ালের বাসিন্দা বাইশ বছরের মনীষা দাস সন্তানসম্ভবা অবস্থায় মেটিয়াবুরুজের একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। দিন তিনেক আগে সন্তানপ্রসবের পরে তরুণীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। এ দিন সকালে তরুণীর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাঁকে এসএসকেএমে রেফার করা হয়। মনীষার স্বামী অজয় দাস জানান, এসএসকেএমের জরুরি বিভাগ থেকে করোনা সন্দেহভাজন হিসেবে রোগিণীকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়। রোগিণীকে নিয়ে প্রথমে মেডিক্যালের ইডেন বিল্ডিংয়ে যান তাঁর পরিজনেরা। শুধু কোভিড পজ়িটিভ রোগীকে সেখানে ভর্তি করা হচ্ছে জানানো হলে স্ত্রীকে নিয়ে জরুরি বিভাগে ফিরে আসেন মনীষার স্বামী অজয় এবং তাঁর দাদা বিজয়। জরুরি বিভাগে গেলে সেখানেও রোগিণীকে ভর্তি নেওয়ার প্রশ্নে টালবাহানা চলে বলে অভিযোগ। যখন রোগিণীকে ভর্তি করানোর জন্য পরিজনেরা ছোটাছুটি করছেন, তখন জরুরি বিভাগের এক পাশে স্ট্রেচারে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন তরুণী। পরিজনেরা সে কথা জানালে রোগিণীকে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অক্সিজেনের নল নাকে গোঁজা অবস্থায় প্রায় দু’ঘণ্টা ও ভাবেই পড়ে থাকেন তরুণী। পরে স্বাস্থ্য ভবনের হস্তক্ষেপে তাঁকে ভর্তি করা হয়।
অজয় বলেন, ‘‘বাড়িতে তিন দিনের সদ্যোজাতকে রেখে এক হাসপাতাল থেকে আর এক হাসপাতালে ঘুরছি। এখানে বলছে, কোভিড পজ়িটিভ রোগীদেরই ভর্তি নেবে। এসএসকেএমে বলছে, করোনা সন্দেহভাজনদের ভর্তি করার কোনও ব্যবস্থা নেই। আমরা গরিব মানুষ কোথায় যাব?’’
আরও পড়ুন: ‘সংখ্যাবৃদ্ধি দেখে বেশি আতঙ্কের কিছু নেই’
কোথায় যাবেন? এই প্রশ্ন গড়িয়ার বাসিন্দা সমীরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীরও। দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করার পরে জরুরি বিভাগের বাইরে একটি কাঠের চেয়ারে সমীরণবাবুকে বসানোর ব্যবস্থা করেন তাঁর স্ত্রী। স্বামীর শ্বাসকষ্টের মাত্রা বৃদ্ধি হলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকদের আর্জি জানিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হন তিনি। এর পর শয্যার অপেক্ষায় প্রায় ঘণ্টা দেড়েক বসে রইলেন ৫০ বছরের প্রৌঢ়। তাঁর স্ত্রী জানান, সকালে স্বামীকে নিয়ে প্রথমে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে জানানো হয়, করোনা সন্দেহভাজন হিসেবে স্বামীর নমুনা পরীক্ষা করানোর জন্য সমীরণবাবুকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, এম আর বাঙুর বা আরজিকরে নিয়ে যেতে হবে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে এলে স্ত্রী জানতে পারেন, সেখানে কোভিড পজ়িটিভ রোগীদের এখন ভর্তি করানো হচ্ছে। অনেক অনুরোধের পরে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সমীরণবাবুর স্ত্রীকে অপেক্ষা করতে বলেন চিকিৎসক। তবে তাঁকে আর ভর্তি করা হয়নি।
আরও পড়ুন: কোভিড-আবহে পরিষেবা নিয়েই প্রশ্ন নীলরতনে
অপেক্ষা থেকে রেহাই নেই কোভিড পজ়িটিভেরও। হাওড়ার নলপুরের বাসিন্দা, ৩৬ বছরের এক যুবক হৃদরোগের সমস্যা নিয়ে এনআরএসে ভর্তি হয়েছিলেন। অস্ত্রোপচারের আগে যুবকের করোনা পরীক্ষা করানো হলে রিপোর্ট পজ়িটিভ আসে। এনআরএস সূত্রের খবর, মেডিক্যাল কলেজে শয্যা নিশ্চিত করে রোগীকে কোভিড হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু মেডিক্যালে আসার পরে পজিটিভ রোগীর অ্যাম্বুল্যান্সের পাইলটকে জানানো হয়, স্বাস্থ্য দফতরের ফোন না পেলে তাঁরা ওই রোগীকে ভর্তি করতে পারবেন না। বিষয়টি জানার পরে এনআরএস কর্তৃপক্ষ আবার মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সমস্যার সমাধান হয়। ততক্ষণে ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গিয়েছে।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের উপাধ্যক্ষ তথা সুপার ইন্দ্রনীল বিশ্বাস বলেন, ‘‘করোনা রোগী ছাড়া করোনা সন্দেহভাজন যে সকল রোগী মৃতপ্রায়, তাঁদেরই এখানে ভর্তির নির্দেশ রয়েছে। ওই প্রসূতির এখানে ভর্তি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মানবিকতার খাতিরে তাঁকে ভর্তি নেওয়া হয়েছে।’’ তা হলে অন্য হাসপাতাল থেকে করোনা সন্দেহভাজনদের কেন মেডিক্যালে পাঠানো হচ্ছে? বাকিদের কাছে বিষয়টি কি স্পষ্ট নয়? উপাধ্যক্ষ বলেন, ‘‘সব রোগীকে ভর্তি নিলে কোভিড পজ়িটিভ রোগীদেরই শয্যা দেওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। সবাই সব কিছু জানেন।’’ এসএসকেএমের উপাধ্যক্ষ রঘুনাথ মিশ্র বলেন, ‘‘জ্বর, শ্বাসকষ্ট হলে আমাদের সে সব রোগীকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজেই পাঠানোর কথা।’’