কাটোয়ায় ফল বিক্রি করছেন সুমন পাল। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়
পেটের দায়ে কাজ করতে গিয়েছিলেন ভিন্ রাজ্যে। ‘লকডাউন’-এ টানা আটকে থাকার পরে বাড়ি ফেরার সময়ে আশা করেছিলেন, ভোগান্তির বোধ হয় অন্ত হল। দুর্ভোগ তার পরেও অপেক্ষা করে আছে, ভাবেননি পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার যুবক সুমন পাল।
মুম্বই থেকে ফিরে দিন দশেক ‘কোয়রান্টিন’ কেন্দ্রে কাটিয়ে যে দিন বাড়ি ঢুকলেন, সে দিনই করোনা-রিপোর্ট ‘পজ়িটিভ’ আসে বছর তেইশের যুবকের। প্রশাসনের কর্মীরা তাঁকে হাসপাতালে পাঠানোর পরে নানা বাড়িতে পরিচারিকার কাজ হারান তাঁর মা। দুর্ব্যবহারের মুখে পড়তে হয় তাঁদেরও, অভিযোগ পড়শিদের। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে অবশ্য সে সবের জন্য মুষড়ে পড়েননি সুমন। সংসারের হাল ধরতে ভ্যানে ফল নিয়ে বিক্রি করতে বেরিয়ে পড়েছেন তিনি। করোনা-মুক্ত হয়েই তাঁর কাজে ফেরাকে কুর্নিশ জানাচ্ছেন প্রতিবেশী থেকে প্রশাসনের কর্তারা। সেই সঙ্গে, করোনা নিয়ে সচেতনতা ও আক্রান্তদের প্রতি সহানুভূতির প্রয়োজন সমাজে, মনে করছেন তাঁরা।
কাটোয়ার আদর্শপল্লির বাসিন্দা সুমনের ছোটবেলায় মৃত্যু হয় বাবার। পরিচারিকার কাজ করে দুই ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন মা বীণা পাল। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বছরখানেক আগে মুম্বইয়ে হোটেলে কাজ করতে যান সুমন। তাঁর কথায়, ‘‘ইচ্ছে ছিল, কিছু টাকা জমিয়ে বাড়ি ফিরে কোনও ব্যবসা করব। কিন্তু এরই মধ্যে লকডাউন শুরু হল।’’ তিনি জানান, কষ্ট করে বেশ কিছু দিন কাটানোর পরে শেষে মরিয়া হয়ে বেরিয়ে পড়েন। কয়েকদফায় ট্রাক পাল্টে ১৮ মে কাটোয়ায় পৌঁছন। স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরে, ‘কোয়রান্টিন’ কেন্দ্রে পাঠানো হয়। উপসর্গ না থাকায় ২৭ মে সেখান থেকে ছাড়া হয় তাঁকে।
আরও পড়ুন: আইসিএসই-র বাকি পরীক্ষা ঐচ্ছিক, বাড়ল কি চাপ?
আরও পড়ুন: দাবিদারহীন মৃতদেহ সৎকারের আদর্শ বিধি তৈরির পথে রাজ্য
সুমন বলেন, ‘‘বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই সন্ধ্যায় পুলিশ-প্রশাসনের কর্মীরা এসে হাজির। করোনা-রিপোর্ট ‘পজ়িটিভ’ এসেছে শুনে প্রথমে হতাশ হয়েছিলাম। কিন্তু দুর্গাপুরের ‘কোভিড’ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে ঠিক করি, এ যুদ্ধে জিততেই হবে।’’ ছ’দিন পরে ফের পরীক্ষায় রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’ আসায়, বাড়ি ফেরানো হয় তাঁকে। কিন্তু এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার কিছু বাসিন্দা তাঁর পরিবার তো বটেই, গোটা পাড়াকে কার্যত ‘একঘরে’ করেন বলে অভিযোগ। বীণাদেবী বলেন, ‘‘গোটা তিনেক বাড়িতে কাজ করতাম। সবাই জানিয়ে দেন, কাজ করতে হবে না। আমার রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’ এসেছে জানালেও, কাজে ফেরাননি।’’ আদর্শপল্লির বাসিন্দা, টোটোচালক উত্তম দেবনাথের অভিযোগ, ‘‘পাড়ার ছেলের করোনা হয়েছে শুনে শহরের অনেকেই আমাদের বাঁকা চোখে দেখছিলেন। কেউ আমার টোটোয় চড়ছিলেন না।’’ সুমন বলেন, ‘‘বাড়িতে ফিরে শুনলাম, আমার করোনা হওয়ায় মা ও পড়শিদের দুর্ব্যবহার সইতে হয়েছে। কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু তা বলে বাড়িতে বসে থাকব না। ফল বিক্রি শুরু করেছি। দিনে শ’খানেক টাকা আয় হচ্ছে।’’ তাঁর মা বলেন, ‘‘ছেলে সেরে উঠে কাজ করছে, এটাই আনন্দের।’’ সুমনের কাছে আম কিনতে এসে স্থানীয় বাসিন্দা মিহির দেবনাথ বলেন, ‘‘করোনা থেকে সেরে ওঠার পরে কাউকে নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই, তা বোঝা দরকার।’’
কাটোয়া পুরসভার প্রশাসক তথা তৃণমূল বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘করোনা নিয়ে কিছু অপপ্রচার সমাজে খারাপ প্রভাব ফেলছে। ওই যুবক সুস্থ হয়ে যে ভাবে রোজগারের চেষ্টা করছেন, তা প্রশংসনীয়।’’ মহকুমাশাসক (কাটোয়া) প্রশান্তরাজ শুক্ল বলেন, ‘‘করোনা-আক্রান্ত ও তাঁর পরিবারের সহানুভূতির প্রয়োজন। এলাকাবাসীদের সচেতন করা হচ্ছে।’’