নয়া কন্টেনমেন্ট এলাকার মধ্যে পড়েছে বাড়ি। উদ্বিগ্ন প্রৌঢ়া। বৃহস্পতিবার উত্তর কলকাতার রাজা রামমোহন সরণিতে। ছবি: সুমন বল্লভ
রাজ্যের কন্টেনমেন্ট এলাকাগুলিতে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা থেকে ফের লকডাউন চালু হল। আর এ দিনই জানা গেল, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১০৮৮। প্রথম করোনা ধরা পড়ার পর থেকে এই প্রথম এ রাজ্যে এক দিনে আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়াল। ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃতের সংখ্যাও এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। বুধবার থেকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের। করোনা সংক্রমণের এই ছবি দেখে এ দিন থেকে কন্টেনমেন্ট জ়োনগুলিতে চালু হওয়া লকডা়উনে কতটা কাজ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
নয়া লকডাউন নিয়ে বিভ্রান্তিও তৈরি হয়েছে আমজনতার মধ্যে। সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, কলকাতা-সহ ২০ জেলায় মোট ৪৩৪টি কন্টেনমেন্ট জ়োন করা হয়েছে। কিন্তু বুধবার লকডাউন সংক্রান্ত সরকারি ঘোষণার পরে শুধু কলকাতা, হাওড়া এবং উত্তর ২৪ পরগনা— এই তিন জেলায় কন্টেনমেন্ট এলাকার তালিকা জানানো হয়েছিল। বাকি জেলাগুলির তালিকা প্রকাশ করতে করতে বৃহস্পতিবার বিকেল গড়িয়ে যায়। সব জায়গার কন্টেনমেন্ট তালিকা আগে থেকে না-জানার কারণেই ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে বলে মানছেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাদের অনেকেই।
এ দিন লকডাউন শুরু হওয়ার আগে বিভিন্ন এলাকায় মাইকে ঘোষণা করে স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু অনেকেরই বক্তব্য, যে সব এলাকা কন্টেনমেন্ট জ়োনের তালিকায় নেই, সেখানেও ঘোষণা করেছে পুলিশ-প্রশাসন। তার ফলেও একটা বিভ্রান্তি দেখা দেয়। প্রশাসন সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, কন্টেনমেন্ট জ়োনে লকডাউন সফল করতে হলে আশপাশের এলাকাতেও জমায়েত বন্ধ করতে হবে এবং সেখানকার বাসিন্দাদের সচেতন করা দরকার। সেই কারণেই এই ঘোষণা।
আরও পড়ুন: দক্ষিণ ২৪ পরগনার নতুন তালিকায় কন্টেনমেন্ট ৫৪
তবে কী কী বিধিনিষেধ আরোপিত হবে, তা নিয়েও বিভ্রান্তি ছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় নয় এমন সব পরিষেবা বন্ধ রাখার কথাই বলা হয়েছে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে। কিন্তু গণপরিবহণ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। ফলে প্রয়োজন হলে গাড়িঘোড়া পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে মানুষের মনে। দোকান কতটা কী খোলা থাকবে, তা-ও প্রশ্ন। প্রশাসনিক সূত্রের অবশ্য দাবি, কন্টেনমেন্ট এলাকাগুলির মধ্যে থাকা ওষুধ বা অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকানগুলিকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। বাজারগুলি বিকেল ৫টার আগেই বন্ধ হয়েছে। আজ, শুক্রবার সকাল থেকে সুফল বাংলার ভ্রাম্যমাণ স্টলগুলি এলাকায় ঘুরবে। অত্যাবশ্যক পণ্যের কোনও অভাব হবে না বলে প্রশাসন আশ্বাস দিলেও এ দিন লকডাউন শুরুর আগে পর্যন্ত দোকানে-দোকানে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
কলকাতার বিভিন্ন কন্টেনমেন্ট জ়োনে এ দিন পুলিশ পিকেট বসানো হয়। আলিপুর, ভবানীপুরের মতো এলাকায় কন্টেনমেন্ট জ়োনের বাসিন্দাদের নিয়ে হোয়্যাটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। তার মাধ্যমে পুর প্রতিনিধি ও পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বাসিন্দারা।
আরও পড়ুন: গোষ্ঠী সংক্রমণ? মানছে না কেন্দ্র, ফের লকডাউন উত্তরপ্রদেশে
এক দিনে সংক্রমণের সংখ্যা হাজার অতিক্রম করার পিছনে যে দু’টি জেলার অবদান সবচেয়ে বেশি তা হল, কলকাতা (৩২২) এবং উত্তর ২৪ পরগনা (২৬৪)। আক্রান্তের মাপকাঠিতে তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থানে যথাক্রমে হাওড়া (১৬৭) এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা (৮৮)। মৃতের সংখ্যাতেও এগিয়ে কলকাতা। কলকাতায় উল্লেখযোগ্য আক্রান্তের তালিকায় রয়েছেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রধান। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের এক পিজিটিও আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে করোনায় মৃত ২৭ জনের মধ্যে ১৩ জনই কলকাতার বাসিন্দা। বাকি ১৪ জনের মধ্যে ছ’জন উত্তর ২৪ পরগনার।
ঘটনাচক্রে, এ দিনই উত্তর ২৪ পরগনার জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তপন সাহাকে বদলির নির্দেশ জারি করেছে স্বাস্থ্য ভবন। তাঁর জায়গায় এসেছেন স্বাস্থ্যভবনে এডিএইচএস (ইপিআই) পদে কর্মরত চিকিৎসক তাপস রায়।
প্রশাসন সূত্রে বলা হচ্ছে, সংক্রমণের বাড়বাড়ন্ত রুখতে কড়া লকডাউনের পাশাপাশি চিকিৎসায় গাফিলতি বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও শুরু হচ্ছে। কোভিড রোগীর চিকিৎসায় এক ডজন গাফিলতির অভিযোগে বারাসতের জিএনআরসি হাসপাতালকে কারণ দর্শানোর নোটিস ধরানো হয়েছে। রক্তে অক্সিজেন পাঠানো এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের অপসারণে ফুসফুস কত ভাল কাজ করছে তা জানার জন্য রোগীর এবিজি (আর্টারিয়াল ব্লাড গ্যাস) পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু ওই হাসপাতালে পরিদর্শনে গিয়ে প্রোটোকল মনিটরিং টিম দেখেন, সেই যন্ত্রই নেই! স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, সেখানে কোনও মাইক্রোবায়োলজিস্টেরও দেখা মেলেনি। ক্যুইক রেসপন্স টিমের উপস্থিতি, প্রতি ঘণ্টায় রোগীর রক্তচাপ, রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা নিরীক্ষণ করার প্রশ্নেও গাফিলতি ধরা পড়েছে। যার প্রেক্ষিতে ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইন মেনে কেন ওই লাইসেন্স বাতিল করা হবে না তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে।
মুখ্যসচিব রাজীব সিংহ বলেন, ‘‘প্রোটোকল মনিটরিং টিমের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরিদর্শনের পরে নিয়মিত নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। যাঁরা এর পরও নির্দেশ মানছেন না তাঁদের শো-কজ করা শুরু করেছে স্বাস্থ্য দফতর।’’