গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
কোভিডে আক্রান্ত চিকিৎসক বাড়ির একতলায় আইসোলেশনে ছিলেন। কিন্তু দোতলায় থাকলেও রবিবার থেকে বছর সত্তরের বৃদ্ধা মায়ের গলাব্যথা শুরু হয়েছে। সারাদিন চেষ্টা করেও মায়ের নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারেননি ওই চিকিৎসক। বেলগাছিয়ার বাসিন্দা বছর পঁয়ষট্টির এক বৃদ্ধা আবার গত কয়েক দিন ধরেই জ্বর, শুকনো কাশি, মাথাব্যথার উপসর্গ নিয়ে বাড়িতে রয়েছেন। শারীরিক ভাবে দুর্বল হওয়ায় বাড়িতেই যাতে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করা যায় সেই জন্য একাধিক বেসরকারি ল্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু দিনভর চেষ্টাতেও বৃদ্ধার কপালে শিঁকে ছেড়েনি। বঙ্গের করোনা মানচিত্রে সংক্রমণের বাড়বাড়ন্তের মধ্যে নমুনা পরীক্ষা নিয়ে হয়রানির এই ছবির মধ্যেই আজ, সোমবার নাইসেডে রোজ তিন হাজার নমুনা পরীক্ষা করার ক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্র ‘কোবাস ৮৮০০’ ও পরীক্ষাগারের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের এ দিনের প্রকাশিত বুলেটিন অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬,০৪৫টি নমুনার মধ্যে ২৩৪১ জনের দেহে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে। রাজ্যে করোনা পজ়িটিভ মৃতের সংখ্যা ৪০ জন। কলকাতার পাশাপাশি জেলাস্তরে সংক্রমণের সংখ্যার ছবিটা মোটের উপর একই রয়েছে। কলকাতা (৬৪৮), উত্তর ২৪ পরগনা (৫৪২), হাওড়া (২৯১), দক্ষিণ ২৪ পরগনা (১৩৩) এবং হুগলির (১২৭) মতো রাজ্যের অন্য জেলাগুলিতেও ধারাবাহিক ভাবে আক্রান্তের সন্ধান মিলছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সংক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে রাজ্যের সর্বত্র নমুনা পরীক্ষার চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী নমুনা পরীক্ষার পরিকাঠামো গত চার মাসেও গড়ে ওঠেনি। চিকিৎসকদের একাংশ জানান, সরকারি ল্যাবে পরীক্ষা করাতে হলে হাসপাতালের ফিভার ক্লিনিকে যেতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা করার ক্ষেত্রেও সেখানকার বহির্বিভাগে যাওয়া জরুরি। সাধারণ মানুষের অনেকের হাসপাতালে যেতে অনীহা রয়েছে। আবার শারীরিক অসুস্থতা, বয়সজনিত কারণের জন্য হাসপাতালে যাওয়া অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়, সেটাও সত্যি। দিল্লি, মহারাষ্ট্র বা কেরলের মতো এ রাজ্যে বুথভিত্তিক নমুনা পরীক্ষা শুরু হয়নি। এই পরিস্থিতিতে বেসরকারি ল্যাবের পরিষেবার উপরে অনেকে নির্ভরশীল। কিন্তু সেই পরিষেবা পেতে গিয়েও হয়রানির শিকার হচ্ছেন মানুষ।
আরও পড়ুন: একটু ধরুন দাদা! মিলল না সাড়া হাসপাতালেই
বেসরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্র সূত্রের খবর, শহরের যে বেসরকারি ল্যাব সবচেয়ে বেশি নমুনা সংগ্রহ করে, শনিবার থেকে তাদের পরিষেবা বন্ধ রয়েছে। পরীক্ষাগার জীবাণুমুক্ত করার কাজ চলায় আজ, সোমবার পর্যন্ত পরিষেবা বন্ধ থাকবে বলে খবর। ফলে ওই ল্যাবের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহকারী ডায়াগনস্টিক সেন্টার আগের মতো পরিষেবা দিতে পারছেন না। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে শহরে কিছু ল্যাব রয়েছে যারা নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ভিন্ রাজ্যে পাঠান। এ ক্ষেত্রে দ্রুত নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া সম্ভব নয়। এ রাজ্যে সংক্রমণের জন্মলগ্ন থেকে টেস্ট-বিতর্কে গোড়াপত্তন হয়েছে। চার মাসেও সেই অবস্থার বদল ঘটেনি বলে মত চিকিৎসকদের একাংশের।
নমুনা পরীক্ষার সেই যন্ত্র।
হিসপ্যাথোলজিস্ট সুকান্ত চক্রবর্তীর পর্যবেক্ষণ, ‘‘যত দিন যাচ্ছে আমাদের রাজ্যে নমুনা পরীক্ষার করানোর সুযোগ কমছে। বেসরকারি ল্যাবগুলিতে আগের তুলনায় নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমেছে। কারণ বলতে পারব না। একে ল্যাবের সংখ্যা কম, তার উপরে যেগুলি আছে সেখানে নমুনা পরীক্ষার শক্তি হ্রাস হওয়ায় দিনদিন পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে।’’
(গ্রাফের উপর হোভার বা টাচ করলে প্রত্যেক দিনের পরিসংখ্যান দেখতে পাবেন। চলন্ত গড় কী এবং কেন তা লেখার শেষে আলাদা করে বলা হয়েছে।)
আরও পড়ুন: ‘সোজা বাংলায়’ পাল্টা ভিডিয়ো বাবুলের, নাম না করে খোঁচা ডেরেককে
কার্ডিয়োথোরাসিক সার্জন কুণাল সরকার বলেন, ‘‘কোভিডের সঙ্গে লড়াইয়ে যে মাপকাঠিতে রাজ্য এখনও পিছিয়ে রয়েছে, তা হল টেস্টিং। এখনও পর্যন্ত আমরা প্রচুর টেস্ট করছি না। আমাদের রাজ্যে এখন টেস্ট পজ়িটিভিটি রেট ১৫ শতাংশের বেশি। যে কোনও রাজ্যের লক্ষ্য হল নমুনা পরীক্ষার সংখ্যাবৃদ্ধির মাধ্যমে পজ়িটিভিটি রেটকে ৫-৭ শতাংশের কাছে নামিয়ে আনা। সংক্রমণের বাড়বাড়ন্ত আটকাতে এটা প্রয়োজন।’’ অ্যাসোসিয়েশন অব হসপিটালস অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার সভাপতি রূপক বড়ুয়া বলেন, ‘‘অনেকে ভীত হয়ে নমুনা পরীক্ষা করাতে চাইছেন। তাতে অহেতুক ল্যাবগুলির উপরে চাপ বাড়ছে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া টেস্ট করানোর কোনও প্রয়োজন নেই। দেখা যাচ্ছে, যাঁর নমুনা পরীক্ষার প্রয়োজন ছিল না, তিনি টেস্ট করিয়ে চলে যাচ্ছেন। আর যাঁর সত্যি প্রয়োজন তিনি হাপিত্যেশ করে বসে রয়েছেন।’’
এই পরিস্থিতিতে ‘কোবাস ৮৮০০’র উদ্বোধনের পরে রাজ্যের নমুনা পরীক্ষার সংখ্যায় বড় পরিবর্তন ঘটবে বলে আশাবাদী চিকিৎসক মহল। নাইসেডের অধিকর্ত্রী শান্তা দত্ত বলেন, ‘‘রাজ্যবাসীর স্বার্থে লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই যন্ত্র চালুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যন্ত্রটির জন্য দু’টি ঘর ভেঙে ৫০০ বর্গফুটের জায়গা করতে হয়েছে।’’ যন্ত্রটি চালানোর জন্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ শেষে ‘কোবাস’ চালু হতে অগস্টের মাঝামাঝি হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন নাইসেডের অধিকর্ত্রী।
(চলন্ত গড় বা মুভিং অ্যাভারেজ কী: একটি নির্দিষ্ট দিনে পাঁচ দিনের চলন্ত গড় হল— সেই দিনের সংখ্যা, তার আগের দু’দিনের সংখ্যা এবং তার পরের দু’দিনের সংখ্যার গড়। উদাহরণ হিসেবে—পশ্চিমবঙ্গে দৈনিক নতুন করোনা সংক্রমণের লেখচিত্রে ১৮ মে-র তথ্য দেখা যেতে পারে। সে দিনের মুভিং অ্যাভারেজ ছিল ১২৮। কিন্তু সে দিন নতুন আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা ছিল ১৪৮। তার আগের দু’দিন ছিল ১১৫ এবং ১০১। পরের দুদিনের সংখ্যা ছিল ১৩৬ এবং ১৪২। ১৬ থেকে ২০ মে, এই পাঁচ দিনের গড় হল ১২৮, যা ১৮ মে-র চলন্ত গড়। ঠিক একই ভাবে ১৯ মে-র চলন্ত গড় হল ১৭ থেকে ২১ মে-র দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যার গড় পরিসংখ্যানবিদ্যায় দীর্ঘমেয়াদি গতিপথ সহজ ভাবে বোঝার জন্য এবং স্বল্পমেয়াদি বড় বিচ্যুতি এড়াতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়)
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)