Coronavirus Lockdown

পাড়ার দোকানে তাও ওয়াক ফ্রম হোম, নামীদামি মিষ্টিরা ছুটিতেই

ছোট-মাঝারি দোকানগুলো খুললেও, কলকাতার ‘ব্র্যান্ডেড’ মিষ্টির দোকানগুলো সরকারের ছাড় পাওয়ার পরও দোকান খোলেননি। এঁদের অনেকেরই রয়েছে একাধিক দোকান।

Advertisement

সিজার মণ্ডল

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২০ ১৮:০৩
Share:

লকডাউনের বাজারেও বাঙালির শেষ পাতে মিষ্টি না হলে চলছে না। —নিজস্ব চিত্র।

প্রতুল দত্ত চাকরি করতেন একটি কেন্দ্রীয় সরকার অধিগৃহীত সংস্থায়। অবসর নিয়েছেন প্রায় ১২ বছর। বৌবাজার এলাকায় বাড়ি। দীর্ঘ অর্ধ শতকের অভ্যেস, রাতে খাওয়ার সময় পাতে একটা সন্দেশ চাই-ই। শীত, গ্রীষ্ম, বারোমাস। এই অভ্যেস বজায় রাখতেও বিশেষ সমস্যা হয়নি তাঁর কোনও দিন। পাড়াতেই রয়েছে দু’টো মিষ্টির দোকান। আর মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই ভীম নাগ, নবকৃষ্ণ গুঁইয়ের মতো নামী মিষ্টির দোকান।

Advertisement

কিন্তু সেই অভ্যেসে ছেদ পড়ল গতমাসের শেষ দিকে লকডাউন ঘোষণার পর। দত্তবাবুর কথায়, ‘‘রাতের খাওয়াটাই মাটি।” প্রতুলবাবু একা নন। এ রকম অনেক মানুষ রয়েছেন গোটা রাজ্যে, যাঁদের কাছে মিষ্টিও অত্যাবশ্যকীয়ের তালিকাতেই পড়ে। আম বাঙালির রসনাতৃপ্তির অঙ্গ মিষ্টি।

আর তাই লকডাউনের মধ্যেই, কেবল মাত্র বাঙালির রসনার কথা চিন্তা করে পয়লা এপ্রিল দুপুর ১২টা থেকে ৪টে পর্যন্ত মিষ্টির দোকান খোলার ছাড়পত্র দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে কয়েকদিন পরেই, ১৬ এপ্রিল সময় বাড়িয়ে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টে করা হয়। ২০ এপ্রিল, ভিড় এবং সামাজিক দূরত্বের কথা চিন্তা করে মিষ্টির দোকান খুলে রাখার সময় কমিয়ে বেলা ১২টা পর্যন্ত করার নির্দেশ দেয় সরকার।

Advertisement

দোকান তো খুলল। ঘর বন্দি বাঙালির পাতে, একঘেয়েমি কাটাতে জোগান এল রসগোল্লা, কালাকাঁদ, চমচম লেডিকেনি সহ হাজারো মিষ্টি। কিন্তু বাস্তবে, প্রতুলবাবুর মতো মানুষরা ছাড়া আর কতজন মিষ্টির দোকানমুখী হলেন এই লকডাউনের বাজারে?

লর্ডসের মোড়ে কল্পনা মিষ্টান্ন ভান্ডার ওই এলাকার সবারই পরিচিত। শোকেসের অনেকটা অংশই ফাঁকা। বেশ অনেকক্ষণের ব্যবধানে হাতে গোনা খদ্দেরের আনাগোনা। বেচাকেনার বহর দেখে বোঝা যাচ্ছে, দোকানদার ইচ্ছে করেই শোকেস ভরেননি। দোকানদারের সঙ্গে ক্রেতাদের কথা-বার্তা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, প্রায় সবাই স্থানীয় এবং নিয়মিত ক্রেতা। দোকানের মালিক ঋজু সেন। ব্যবসাপাতির হাল জানতে চাইলে হেসে জবাব দেন, ‘‘দোকান বন্ধের থেকে খুললে ক্ষতি বেশি।” ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘‘দেখুন, বিক্রি এমনি দিনের নিরিখে ২০-২২ শতাংশ। তাও মূলত একদম পাড়ার বাসিন্দা যাঁরা, তাঁরাই আসছেন।”

লর্ডস মোড়ে একটি মিষ্টির দোকানে চলছে বেচাকেনা। —নিজস্ব চিত্র।

একই কথা বলেন, বাগুইআটির একটি মাঝারি মিষ্টির দোকানের মালিক এসকে ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘সমস্যা আমাদের অনেকগুলো। প্রথমত, মিষ্টি বানানোর অধিকাংশ কারিগরই বাড়ি চলে গিয়েছেন। হাতে গোনা তিন-চারজন রয়েছেন। তাঁদের দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় নিয়মিত ক্রেতা ছাড়া, বাইরের পথচলতি ক্রেতা যাঁরা আমাদের অনেকটা বড় ভরসা তাঁরা নেই।” ফলে মাঝারি দোকানগুলো মিষ্টির পরিমাণ এবং ভ্যারাইটি দুটোই অনেক কমিয়ে দিয়েছে। ঋজু বলেন, ‘‘মানুষ কিনতেও ভয় পাচ্ছেন। যে ক্রেতা আগে ২০ টাকা দামের সন্দেশ কিনতেন। তিনিই এখন ১০-১২ টাকা দামের মিষ্টি খুঁজছেন। তাই আমরাও দামি মিষ্টি বানানো বন্ধ করে দিয়েছি। কম দামের মিষ্টিই বানাচ্ছি।”

ঋজু বা এসকে ঘোষের মতো মাঝারি দোকানদারদের বক্তব্য, ‘‘বৈশাখ মাসে আমাদের বিয়ের একটা বড় বরাত থাকে। এ বছর সেই বাজারটা পুরো ক্ষতি হয়েছে।”

লোকসানের কথা শুনিয়েছেন জগন্নাথ ঘোষও। পশ্চিমবঙ্গ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘‘আমরাই মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছিলাম মিষ্টির দোকান খোলার অনুমতি দিতে। রাজ্যে প্রায় ১ লাখ মিষ্টির দোকান। আর তার জন্য প্রতিদিন দরকার হয় প্রায় ৫০ কোটি টাকার দুধ। মিষ্টির দোকান বন্ধ হওয়ায় সেই দুধ নষ্ট হচ্ছিল।” জগন্নাথ এ দিন বলেন, ‘‘দোকান খোলা থাকায় বড় বা মাঝারি দোকানদারদের খুব একটা লাভ হয়নি। তবে কিছুটা সুবিধা হয়েছে পাড়ার ছোট দোকানগুলোর।”

তবে পাড়ার ‘ওয়াক ফ্রম হোম’ দোকানগুলিতে ছবিটা একটু আলাদা। শ্যামপুকুর এলাকায় একটি বাই লেনে ছোট্ট মিষ্টির দোকান। মিষ্টির সঙ্গে সঙ্গে দোকানে পাওয়া যায় ঠান্ডা পানীয়, দুধের প্যাকেট। দোকান চালাচ্ছিলেন এক কর্মী। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের আগাগোড়াই পাড়ার ক্রেতাদের উপর নির্ভর। তাঁরা আসছেন। বরং আগের থেকে বেশি আসছেন কারণ বাইরে যেতে পারছেন না।” মিষ্টির সঙ্গে বিক্রি বেড়েছে ঠান্ডা পানীয়েরও। কয়েক দিন হল সকালের দিকে অল্প স্বল্প কচুরি-সিঙ্গারাও বানাচ্ছেন তাঁরা।

ছোট-মাঝারি দোকানগুলো খুললেও, কলকাতার ‘ব্র্যান্ডেড’ মিষ্টির দোকানগুলো সরকারের ছাড় পাওয়ার পরও দোকান খোলেননি। এঁদের অনেকেরই রয়েছে একাধিক দোকান। যেমন কে সি দাস। সংস্থার ডিরেক্টর ধীমান দাস বলেন, ‘‘আমাদের আটটা দোকান। সব ক’টাই বন্ধ। খুলে কী করব?” তাঁর ব্যখ্যা, ‘‘আমাদের দোকানগুলো কলকাতা শহরের প্রাণকেন্দ্রে, অফিস পাড়ায়, বড় মার্কেট কমপ্লেক্সে। সেখানে লকডাউনের জন্য লোকজন নেই। দোকান খুললেই বা কিনবে কে?” বড় দোকানগুলোর আরও সমস্যা কর্মী নিয়ে। ধীমান বলেন, ‘‘আমাদের এত কর্মী। তাঁদের আনব কী করে? তা ছাড়া তাতে ঝুঁকি থেকে যায়।” ধীমানের হিসাবে, দোকান খুললে বেশি লোকসান তাঁদের। কেসি দাসের মতোই দোকান খোলেনি ভীম নাগ, সেন মহাশয়ের মতো বড় দোকানগুলো। জগন্নাথ বাবু বলেন, ‘‘চিত্তরঞ্জন, নকুড়ের মতো দোকানগুলো কয়েক দিন খুলেছিল বলে শুনেছি। তারপর পড়তায় না পোষানোয় বন্ধ করে দিয়েছে।”

যদিও এদের মধ্যে কিছুটা ব্যতিক্রম ফেলু মোদক। হুগলির এই নামী মিষ্টি বিক্রেতা সংস্থার অন্যতম মালিক বৈদ্যনাথ ঘোষের কথায়, ‘‘নাম কা ওয়াস্তে খোলা রাখা হয়েছে। লাভ এটুকুই, যে বাসনপত্রগুলো নিয়মিত ধোয়া মোছা হচ্ছে।” জগন্নাথ শেষে বলেন, ‘‘মানুষের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। রোগের আতঙ্ক, ভবিষ্যত নিয়ে আতঙ্ক।” আর তাই এই লকডাউনে বোধহয়, বাঙালির পাতে মিষ্টি তার ‘অত্যাবশ্যক’ তকমা হারাচ্ছে ধীরে ধীরে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement