নবান্নে চলছে থার্মাল স্ক্রিনিং। হ্যান্ড-স্যানিটাইজ়ারের ব্যবস্থাও হয়েছে। বুধবার। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
করোনাভাইরাস প্রতিরোধ-প্রস্তুতিতে স্বরাষ্ট্র দফতরের তরফে তিনিই ছিলেন অন্যতম প্রতিনিধি। অথচ, স্বরাষ্ট্র দফতরের সেই বিশেষ সচিব তাঁর লন্ডন থেকে আসা করোনা-আক্রান্ত তরুণ পুত্রের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে চরম ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’র পরিচয় দিয়েছেন বলে মনে করছে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষমহল। সোমবার এম আর বাঙুর হাসপাতালের চিকিৎসক ওই তরুণকে আইডি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেও তাঁর মা তা না-করে ছেলেকে নিয়ে দক্ষিণ শহরতলির একটি শপিং মল হয়ে মহাকরণে যান। সেখান থেকে যান নবান্নে। অবশ্য ছেলেকে ছাড়াই নবান্নে ঢোকেন তিনি। যান ১৩ তলায় স্বরাষ্ট্রসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসে। সেখানে করোনা নিয়ে সীমান্ত-সুরক্ষার বৈঠকে যোগ দেন।
ওই আমলার কাজে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও যে ক্ষুব্ধ, বুধবার তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘রাজ্যে আইন জারি করেছি। যাঁরা বিদেশ থেকে আসছেন, প্রত্যেকের কাছে অনুরোধ ভিআইপি-এলআইপি মনোভাবের জায়গা নেই। কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো ঘুরে বেড়িয়ে অনেক লোকের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হল। আমার বাড়িতে যা নিয়ম, আপনার বাড়িতেও একই নিয়ম হবে।’’
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘বিদেশ থেকে এসে শপিং মল, পার্কে ঘুরে এলাম। কারণ, আমার পরিবারের কেউ খুব প্রভাবশালী। তাই পরীক্ষা করালাম না! ইউকে থেকে করোনা নিয়ে এলেন কলকাতায়। আমার রোগ যাতে না-ছড়ায়, কেন তা দেখব না? ডাক্তার বলার পরেও ঘুরে বেড়িয়েছে। দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ হলে সরকার ব্যবস্থা নেবে।’’ ওই আমলার শাস্তির সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা চলছে নবান্নে।
তরুণের গতিবিধি
• বিমানবন্দরে উপসর্গ দেখা দেয়নি। ফর্মেও তথ্য নেই।
• সোজা আবাসনে চলে যান।
• সোমবার মায়ের সঙ্গে এমআর বাঙুর হাসপাতালে।
• ডেপুটি সুপারের ঘরে তাঁকে পরীক্ষা করোনা সংক্রান্ত নোডাল অফিসারের। সঙ্গে রোগী সহায়ক। বেলেঘাটা আইডি-তে যাওয়ার পরামর্শ। তাঁরা যান শপিং মলে।
মা কোথায় গিয়েছিলেন
• সোমবার নবান্নে ঢুকে লিফটে চেপে তেরোতলায়।
• প্রথমে স্বরাষ্ট্রসচিবের ব্যক্তিগত সচিবের ঘরে নথির ফোটোকপি করান। স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে আধ ঘণ্টা বৈঠক। তার পরে মহাকরণে।
বাবা কোথায় গিয়েছিলেন(কৃষ্ণনগর পুরসভার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ)
• সোমবার কলকাতার আবাসনে বিলেতফেরত ছেলের সঙ্গে দেখা করেন। কৃষ্ণনগরে ফিরে সোমবার ও মঙ্গলবার অফিসে। বাড়িতে রোগীও দেখেন।
• মঙ্গলবার বিকেলে জেলা প্রশাসনের এক কর্তার সঙ্গে বৈঠক। আরও অনেকের সঙ্গেই দেখা করেছেন।
• মঙ্গলবার রাতে অ্যাম্বুল্যান্সে বেলেঘাটা আইডিতে।
এঁদের সংস্পর্শে কারা এসেছিলেন
• লন্ডন-কলকাতা উড়ানে ৭০ জন যাত্রী এবং ৭ জন কর্মী ( আরও অনেক লোক তাঁদের সংস্পর্শে এসেছেন, ওই ফ্লাইটের ক্রু আরও কয়েকটি উড়ান চালিয়েছেন), আবাসনের বাসিন্দারা।
• তরুণটি বসেছিলেন ১১এফ আসনে।
• তরুণের বাবার সংস্পর্শে গাড়িচালক, পুরসভা ও জেলা প্রশাসনের কর্মী, রোগী ও তাঁদের পরিজন।
• তরুণের মায়ের সংস্পর্শে নবান্ন ও মহাকরণে সহকর্মীরা এবং গাড়িচালক।
এখনও পর্যন্ত কারা কোয়রান্টিনে
• এম আর বাঙুরের রোগী সহায়ক ও নোডাল অফিসার ২ সপ্তাহের জন্য হোম কোয়রান্টিন।
• আক্রান্তের মা, বাবা ও দুই গাড়িচালক বেলেঘাটা আইডিতে।
• জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে ডেপুটি সুপারের ঘর, নবান্ন।
বাকিদের খোঁজ
• ওই উড়ানের তথ্য নিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর।
• চিকিৎসকের চেম্বারের রোগীদের সন্ধানে জেলা প্রশাসন।
তবে শুধু করোনা-আক্রান্ত তরুণটির মা নন, তাঁর বাবার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তিনি পেশায় শিশু চিকিৎসক। থাকেন কৃষ্ণনগরে। চাকরি করেন সেখানকার পুরসভায়। জানা যাচ্ছে, তিনি নিজের গাড়ি নিয়ে কলকাতার ফ্ল্যাটে গিয়ে ছেলের সঙ্গে দেখা করেন। পুরসভা ও জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, সোম ও মঙ্গলবার দু’দিনই তিনি পুরসভায় গিয়ে বিকেল পর্যন্ত থেকেছেন। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যথারীতি প্রাইভেট চেম্বারে বেশ কয়েকটি শিশুকে দেখেছেন। তার পর রাতে রোজকার মতো সদর হাসপাতাল মোড়ে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। বুধবার সন্ধ্যায় আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে তিনি অবশ্য বলেন, ‘‘আমি বিমানবন্দরে যাইনি। ছেলের ফ্লাইট ভোর ৩টেয় নেমেছিল। বিকেলে আমি কলকাতার ফ্ল্যাটে যাই। ছেলে মাস্ক পরে একটা ঘরে একাই ছিল। আমি সেই ঘরেও ঢুকিনি। বাইরে থেকেই কথা বলেছি। ঘণ্টাখানেক থেকে রাতেই কৃষ্ণনগরে ফিরে যাই।’’
প্রশাসনিক কর্তাদের অনেকের মতে, দায়িত্বশীল আমলা হিসেবে ওই তরুণের মায়ের যা করণীয় ছিল, তাতে তিনি অবহেলা করেছেন। গত রবিবার ভোরে লন্ডন থেকে আবুধাবি হয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে নামেন ওই তরুণ। প্রশ্ন উঠেছে, বিমানবন্দরেই তাঁর পরীক্ষা হল না কেন? কী ভাবে তিনি বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পেলেন? তবে কি বিমানবন্দরে তাঁকে ‘বাড়তি সুবিধা’ দেওয়া হয়েছিল? এ ব্যাপারে বিমানবন্দরের কর্তারা স্পষ্ট করে কিছু না-বললেও তাঁদের বক্তব্য, বাড়তি সুবিধা পেতে প্রায়ই ফোন আসে তাঁদের কছে। করোনা-পরিস্থিতিতেও তদ্বিরের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
ওই তরুণ ও তাঁর মা বিমানবন্দর থেকে কলকাতার ফ্ল্যাটে যাওয়ার পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফোন করে তাঁদের জানানো হয় যে, সপ্তাহখানেক আগে সেখানে অনুষ্ঠিত পার্টিতে উপস্থিত এক তরুণীর শরীরে করোনাভাইরাসের হদিস মিলেছে। তিনি ওই তরুণের বান্ধবী এবং দু’জনে একসঙ্গে পার্টিতে নেচেছিলেন। ফলে ওই তরুণেরও পরীক্ষার প্রয়োজন। এর পরেই সোমবার বাঙুর হাসপাতালে যান তাঁরা। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকের পরামর্শ না-শুনে ঘুরে বেড়ান শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার আইডি-তে গেলে ওই তরুণের শরীর থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা হয় ও করোনা ধরা পড়ে। তরুণের পাশাপাশি তাঁরা বাবা-মা, দুই ড্রাইভার এবং দুই পরিচারিকাকেও আপাতত কোয়রান্টিনে রাখা হয়েছে।
রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, বিমানবন্দর থেকে সরাসরি ওই তরুণের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে পর্যবেক্ষণে রাখা হলে এই বিপত্তি হত না। নবান্নতে আতঙ্ক ছড়াত না। প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলের তোপের মুখে ওই আমলা তাঁর ছেলের স্বাস্থ্যপরীক্ষা এবং সংক্রমণ সংক্রান্ত বিস্তারিত ব্যাখ্যা ইতিমধ্যেই স্বরাষ্ট্র দফতরে জানিয়েছেন বলে খবর।