মৃত জিনারুন হক। —নিজস্ব চিত্র
জ্বর, হাঁচি-কাশি আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে সৌদি আরব থেকে শনিবারেই ঘরে ফিরেছিলেন তিনি। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার মৃত্যু হল বছর তেত্রিশের সেই যুবকের।
রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী জানান, ওই যুবক ডায়াবিটিস মেলিটাসে আক্রান্ত ছিলেন। রক্তে শর্করার পরিমাণ ৫৫০ মিলিগ্রামের বেশি ছিল। ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস হলেও জ্বর, শ্বাসকষ্ট, বমি হতে পারে। ‘‘আমরা জেনেছি, ওই যুবক পাঁচ দিন ইনসুলিন নিতে পারেননি। সেই জন্য তাঁর শারীরিক অবস্থার খুবই অবনতি হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে ওই যুবকের করোনাভাইরাস ছিল বলে মনে হচ্ছে না। রবিবারেই কলকাতার নাইসেডে (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজ়িজ়েস) মৃতের লালারসের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে এলে নিশ্চিত ভাবে এই বিষয়ে কিছু বলা সম্ভব হবে,’’ বলেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা।
মৃত্যুর কারণ জানতে দেহের ময়না-তদন্ত হবে কি? স্বাস্থ্য অধিকর্তা জানান, যে-হেতু নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, তাই আর ময়না-তদন্তের প্রয়োজন নেই।
আরও পড়ুন: রত্নার উত্থানে আগুনে ঘি! শোভন শিবিরে তৎপরতা, আসরে বিজেপি-ও
মৃতের নাম জিনারুল হক (৩৩)। নবগ্রামের পলাশপুকুর অঞ্চলের ওই বাসিন্দা সৌদি আরবের একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় এক বছর ধরে সাফাইকর্মীর কাজ করছিলেন। পারিবারিক সূত্রের খবর, সম্প্রতি ফোনে জিনারুল জানিয়েছিলেন, তিনি যে-হাসপাতালে কাজ করতেন, সেখানে বিভিন্ন সংক্রমণ নিয়ে রোগীরা ভর্তি হচ্ছিলেন। তারই মধ্যে কাজ করতে করতে ওই যুবক নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। সৌদি আরবে চিকিৎসা এবং ওষুধের খরচ খুব বেশি। তাই ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন তিনি।
নজর জেলায় জেলায়
মুর্শিদাবাদ
• চিন, ইটালি, ইরান, সৌদি আরব থেকে ফেরা ২২ জনের উপরে নজরদারি। ১৪ জন হাসপাতালে ভর্তি।
পশ্চিম মেদিনীপুর
• চিন, তাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর থেকে ফেরা ১৭ জন চিহ্নিত। ১২ জনের উপরে নজরদারি। পাঁচ জনের খোঁজ মেলেনি।
পূর্ব বর্ধমান
• চিন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ফেরা বর্ধমানের ১৫ জনকে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য দফতর। নজরদারি চলছে।
কলকাতা
• বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে নতুন তিন জন-সহ ভর্তি পাঁচ।
বাঁকুড়া
• চিন থেকে ফেরা পাঁচ জনের উপরে নজরদারি।
আলিপুরদুয়ার
• ফালাকাটা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের ‘আইসোলেশন’ ওয়ার্ডে দু’জন ভর্তি।
জলপাইগুড়ি
• জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের আইডি-তে ভর্তি কেরল-ফেরত এক জন।
পশ্চিম বর্ধমান
• দিল্লিতে বেসরকারি উড়ান সংস্থায় কর্মরত এক যুবক সম্প্রতি দুর্গাপুরে ফিরে জ্বর, সর্দিকাশি নিয়ে ডিএসপি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
শনিবার সকালে এমিরেটসের উড়ানে দুবাই থেকে কলকাতা বিমানবন্দরে নামেন জিনারুল। বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি ধরে তিনি আসেন ধর্মতলায়। তার পরে বাস ধরে পৌঁছন বহরমপুরে। নবগ্রামের বাড়ি ঢুকতে রাত ৯টা বেজে গিয়েছিল। জিনারুলের এক আত্মীয়, মাহাতাব শেখ বলেন, ‘‘রাতে বাড়ি ফেরার পরেই ওর শ্বাসকষ্ট ও বমি শুরু হয়। রবিবার সকালে ওকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল।’’ স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, বাসে একাধিক বার বমি করেছিলেন ওই যুবক।
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সুপার দেবদাস সাহা বলেন, ‘‘প্রথমত যুবক সৌদি আরব থেকে এসেছিলেন। তার উপরে জ্বর, হাঁচি-কাশি ও শ্বাসকষ্টের লক্ষণ থাকায় তাঁকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়। তাঁর চিকিৎসায় সাধ্যমতো সব রকম চেষ্টাই করা হয়েছে।’’ জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রশান্ত বিশ্বাস জানান, ওই যুবকের সংস্পর্শে এসেছিলেন, এমন ১৪ জনকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে পর্যবেক্ষণে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ১৪ জনের মধ্যে ১১ জন নবগ্রাম হাসপাতালে এবং তিন জনকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে পর্যবেক্ষণে আছেন। এর আগে বিদেশ ও ভিন্ রাজ্য থেকে আসা ২২ জনকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
এই ধরনের পদক্ষেপকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবেই বর্ণনা করেছেন স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকেরা। মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা বলেন, ‘‘অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। এই রোগ নিয়ন্ত্রণে সব রকম প্রস্তুতি চালানো হয়েছে।’’
এই ঘটনার জেরে বিমানবন্দরে স্বাস্থ্যপরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের নির্দেশিকা অনুযায়ী সৌদি-ফেরত ওই যুবকের বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার কথা। মৃতের পরিজনদের দাবি, বিমানবন্দরে স্বাস্থ্যপরীক্ষা হয়েছিল। তা হলে জ্বর, হাঁচি-কাশি, শ্বাসকষ্ট থাকলেও জিনারুলকে কেন অন্যদের মতো বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে পাঠানো হল না, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, চিকিৎসকদের একাংশ মনে করছেন যে দু’জন জিনারুলকে আনতে গিয়েছিলেন শুধু তাঁরা নন, জিনারুলের পরিবারের বাকি সমস্ত সদস্য, জিনারুল যে গাড়িতে এসেছিলেন সেই যাত্রীরা অর্থাৎ জিনারুলের সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের সকলকেই আইসোলেশনে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এমনকি, রিয়াদ থেকে দুবাই হয়ে যে বিমানে তিনি কলকাতায় পৌঁছন, তাঁদেরকেও চিহ্নিত করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘জিনারুল রওনা হওয়া থেকে তাঁর হাসপাতাল পৌঁছনো পর্যন্ত অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁদের চিহ্নিত করতে অনেকটা সময় প্রয়োজন।’’ সেই সঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘‘যদি জিনারুল আগেই আক্রান্ত হয়ে থাকতেন, তা হলে বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্রিনিং টেস্টে ধরা পড়া উচিত ছিল। এ ক্ষেত্রে জিনারুল ওই টেস্ট পাশ করে গিয়েছিলেন। তাই আমরা প্রাথমিক ভাবে তাঁর পরিবারের লোকজনের উপরেই নজর রাখার ব্যবস্থা করছি।’’
এ বিষয়ে কলকাতা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী চিকিৎসক ও কর্মীরা বিদেশ থেকে আসা প্রত্যেক যাত্রীকে পরীক্ষা করছেন। বিমানবন্দরে যাঁরা সরাসরি এই স্বাস্থ্যপরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত, সেই দুই চিকিৎসক রমা নাগ ও মানস কুণ্ডু এ দিন ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি।
জিনারুলের মতো একই রকম উপসর্গ নিয়ে এ দিন সকালে এমিরেটসের উড়ানে মিনারুল শেখ নামে এক যুবক কলকাতায় ফেরেন। বিমানবন্দর-কর্তৃপক্ষ জানান, তাঁকে বেলেঘাটা আইডি-তে পাঠানো হয়েছে। যদিও আইডি-র অধ্যক্ষা অণিমা হালদার জানিয়েছেন, এই নামে কোনও রোগী ভর্তি হয়েছেন বলে তাঁর জানা নেই।