করোনা আতঙ্কে সবার মুখে মাস্ক কলকাতা বিমানবন্দরে। ছবি: পিটিআই
গণ জমায়েত না করা করোনাভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ রোখার অন্যতম প্রধান এবং প্রাথমিক শর্ত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর তাই কেন্দ্রীয় সরকার হোক বা রাজ্য সরকার বার বার মানুষকে জমায়েত থেকে দূরে থাকার আবেদন করছেন। ইতিমধ্যেই এ রাজ্যে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। আর সেই আবহেই রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যে এই মুহূর্তে পুর নির্বাচন করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত?
চিকিৎসকরা কিন্তু স্পষ্ট জানাচ্ছেন, ভোট হোক বা খেলার মাঠ, করোনাভাইরাসকে রুখতে কোনও ধরনের জমায়েতই কাম্য নয়। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ শ্যামাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, গণ জমায়েত করা কোনও ভাবে উচিত নয়। তিনি বলেন, “ভোট মানেই তো রাজনৈতিক দলগুলির প্রচার, জনসভা, ভোটের লাইন। তার মানেই তো প্রচুর মানুষ খুব কাছাকাছি চলে আসছেন। আর সেটা এড়ানোটাই এই রোগকে রোখার মূল শর্ত।” শ্যামাশিসবাবুর মতে, ‘‘আমাদের কাছে কোনটা বেশি প্রাধান্য সেটা ঠিক করতে হবে। ভোট আমাদের প্রাধান্য, না আগে দরকার রোগটা আটকানো?” তিনি বলেন, “আমাদের আগে কোভিড-১৯ ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়াটা আটকাতে হবে। আর সেই লড়াইয়ে আমাদের হাতে যে অনেক অস্ত্র বা উপায় রয়েছে তা নয়। এমনিতেই আমাদের মতো ঘনজনবসতিপূর্ণ দেশে এই রোগের সংক্রমণ রোখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আর তাই সরকার সব রকম ভাবে চেষ্টা করছে। স্কুল কলেজ বন্ধ করা হয়েছে। গণ জমায়েত না করতে বলা হয়েছে। আর তাই আমরা এমন কোনও কাজ করব না, যাতে সংক্রমণ ছড়ায়।” শ্যামাশিসবাবু বলেন, “ভোট এখনই করতে হবে এমন কোনও মানে নেই। কিছু দিন পরেও করা যাবে।”
শ্যামাশিসবাবুর মতোই গণ জমায়েতের বিরোধিতা করেছেন ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেল্থের চিকিৎসক প্রভাস প্রসূন গিরি। তাঁর কথায়, “নির্বাচন মানে যদি শুধু ভোট গ্রহণ পর্ব হতো, তা-ও একরকম ছিল। কারণ সেখানে নিরাপত্তা রক্ষীরা আছেন। গোটা ব্যাবস্থা সংগঠিত করার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু ভোটের সঙ্গে তো আরও অনেক কিছু জুড়ে রয়েছে।” নিজের কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ভোট মানেই তো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা হবে। মিছিল হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার হবে। সেখানে তো সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের আশঙ্কা। কারণ সেখানে কে কার সংস্পর্শে আসছে তার উপর তো কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।”
আরও পড়ুন: করোনা-আতঙ্কে পুরভোট কবে, ধন্দে রাজ্যের সবক'টি দলই
প্রভাসবাবু সেই সঙ্গে মনে করিয়ে দেন যে, সারা বিশ্বের যা ট্রেন্ড, তাতে দেখা যাচ্ছে ৬০ বছরের বেশি বয়স যাঁদের এবং যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস বা ফুসফুসের দীর্ঘদিনের রোগ রয়েছে তাঁদের সংক্রামিত হওয়ার প্রবণতা বেশি। সেই সঙ্গে ওই সংক্রমণ তাঁদের শরীরে ছড়ায়ও বেশি। তিনি গোটা বিশ্বের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ‘‘গোটা বিশ্বে এখনও পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তার মধ্যে আশি বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রায় ১৩-১৫ শতাংশ। যঁদের বয়স ৭০ বছরের বেশি কিন্তু ৮০ বছরের কম তাঁদের ক্ষেত্রে সেই মৃত্যুর হার ৭-৯ শতাংশ। ৬০ বছর থেকে ৭০ বছরের মধ্যে যাঁদের বয়স তাঁদের এই হার ৪ শতাংশ।”
আরও পড়ুন: ‘আটক’ বিধায়ক ফেরাতে শাহকেই চিঠি কমল নাথের
প্রভাসবাবু এই পরিসংখ্যান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘‘বয়স্ক মানুষেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গণ জমায়েতে অংশ নিচ্ছেন না। কিন্তু তাঁদের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়াচ্ছে পরিবারের কমবয়সি সদস্যদের মাধ্যমে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও আপাত ভাবে সাধারণ সর্দি-কাশির মতোই মনে হবে। কমবয়সিদের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারছে না এই ভাইরাস। কিন্তু তাঁদের কাছ থেকেই সবার অজান্তে ওই ভাইরাস আক্রমণ করছে পরিবারের বয়স্কদের। তাঁদের ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে সমস্যা।” সব রাজনৈতিক দলেরই কর্মীদের একটা বড় অংশ কমবয়সি। নির্বাচনের মতো কর্মসূচিতে তাঁরাই সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাই তাঁদের উদ্দেশে প্রভাসবাবুর সতর্কবার্তা, ‘‘পরিবারের যুবা সদস্যদের জমায়েত এড়িয়ে চলতে হবে পরিবারের বাকিদের সুরক্ষার স্বার্থে।”