পুরভোট পিছিয়ে দেওয়া নিয়ে একমত সব দলই। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
করোনা সঙ্কটের ছায়ায় পুরভোট পিছিয়ে যাওয়া প্রায় অবধারিত হয়ে উঠল। সংক্রমণ রুখতে যে কোনও ধরনের জমায়েত এড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছিল প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য বিভাগ। বাংলার বিজেপি শনিবার থেকেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিল, এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যাওয়া সম্ভব কি না? রবিবার রাতে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলও বিবৃতি প্রকাশ করে স্পষ্ট জানিয়ে দিল, নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোট পিছিয়ে দেওয়ার সুপারিশই করবে তারা। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসও জানাল, বিপদের আশঙ্কায় রাজ্য সরকার ভোট পিছনোর সিদ্ধান্ত নিলে তা সমর্থন করা হবে। এমনকি কমিশন পুরভোট পিছিয়ে দিলে বিরোধিতা করা হবে না বলে জানাল বামেরাও। অর্থাৎ আজ, সোমবারের সর্বদল বৈঠকে শাসক-বিরোধী এক সুরে ভোট পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করতে চলেছে। কমিশনও সেই মতোই সায় দিতে পারে বলে রাজনৈতিক শিবিরে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে।
আনন্দবাজার ডিজিটালের তরফ থেকেই সর্বাগ্রে এই সঙ্কটের কথা তুলে ধরা হয়েছিল। শুক্রবার থেকে সাধারণ নাগরিক এবং রাজনৈতিক শিবিরের সামনে আমরা এই প্রশ্ন রাখছিলাম যে, করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে যদি জমায়েত এড়াতেই হয়, তা হলে এই মুহূর্তে ভোট ঘোষণা করা কি উচিত হবে? রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল এবং তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি-ও সেই একই উদ্বেগ প্রকাশ করল। সোমবার নির্বাচন কমিশনের ডাকা বৈঠকেও সেই উদ্বেগেরই প্রতিফলন ঘটতে চলেছে।
তৃণমূল মহাসচিব তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় রবিবার সন্ধ্যায়ই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। করোনা সঙ্কটের আবহে ভোট করা আদৌ উচিত কি না, তা নিয়ে তৃণমূলে আলোচনা শুরু হয়েছে বলে তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছিলেন। পার্থ প্রথমে জানান, রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ যে এই পরিস্থিতিতে ভোট করানো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা তিনি জানেন। তার পরে তিনি বলেন যে, বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলের মধ্যেও আলোচনা শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক নয়, অস্বাভাবিক, এমন মন্তব্যও করেন পার্থ। তখনই আঁচ পাওয়া গিয়েছিল যে, ভোট পিছনোর আলোচনায় তৃণমূলের অবস্থান কোন দিকে ঝুঁকে। পার্থর এই সাংবাদিক সম্মেলনের কয়েক ঘন্টার মধ্যে নিজেদের অবস্থান পুরোপুরি স্পষ্ট করে দেয় তৃণমূল।বিবৃতি প্রকাশ করে রাজ্যের শাসক দলের তরফে জানানো হয়, নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোট পিছিয়ে দেওয়ার আবেদনই জানাবে তৃণমূল। বিবৃতিতে লেখা হয়, ‘আমরা সকলেই করোনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইতিমধ্যেই করোনাকে অতিমারী হিসাবে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। রাজ্য সরকার নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ করেছে। এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে আমরা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করব যে, আসন্ন পুরসভা নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হোক।’
পুরভোটের বিষয়ে আলোচনা করতে আজ সর্বদল বৈঠক হবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনে। সেখানে তৃণমূল কী বলবে, তা রবিবারই বিবৃতি দিয়ে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তবে বিজেপি কিন্তু বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই ওই একই সুর ধরেছিল। করোনা সঙ্কটের মাঝে ভোট কী ভাবে সম্ভব, সে প্রশ্ন শনিবার থেকেই তোলা শুর করেছিলেন বিজেপি নেতারা। রবিবার বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য মুকুল রায় আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে অতিমারী (প্যানডেমিক) ঘোষণা করেছে। ভারত সরকার একে বিপর্যয় বলে মনে করছে। এ রাজ্যের সরকারও জমায়েত এড়াতে ইতিমধ্যেই স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়েছে। ক্রিকেট ম্যাচ, ফুটবল ম্যাচ পিছিয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি সঙ্কটজনক না হলে তো এ সব করার দরকার ছিল না। সে কথা মাথায় রেখেই আমাদের ভাবতে হচ্ছে যে, এই পরিস্থিতির মধ্যে ভোটটা হবে কী করে?’’
পুরভোট সময় মতো করানোর বিষয়ে এত দিন অন্য বিরোধী দলগুলোর মতো বিজেপি-ও সরব ছিল। রাজ্যের বিভিন্ন পুরসভার মেয়াদ বছর খানেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, সে সব জায়গায় প্রশাসক বসিয়ে যে ভাবে ভোট আটকে রেখেছিল রাজ্য সরকার, তার বিরুদ্ধে বিজেপি, কংগ্রেস ও সিপিএম একযোগে সরব ছিল। কিন্তু করোনা সঙ্কটের প্রেক্ষিতে সর্বাগ্রে মত বদলায় বিজেপি। এই মুহূর্তে নির্বাচন করানো যাবে কি না, সে কথা পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে বিজেপি নেতারা মন্তব্য করতে শুরু করেন। মুকুল রায় বলেন, ‘‘নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া উচিত বা এখন নির্বাচন করতে দেব না— এ সব কথা আমরা বলছি না। কিন্তু করোনার সংক্রমণে গোটা বিশ্ব যে ত্রস্ত, সেটাও তো মানতে হবে। সারা পৃথিবীতেই সতর্কবার্তা জারি হয়েছে। লোকজনকে ভিড় বা জমায়েত বা জনবহুল এলাকা এড়িয়ে থাকতে বলা হচ্ছে। ভোট ঘোষণা হয়ে গেলে সেগুলো এড়ানো তো আর সম্ভব হবে না। সেই কারণেই বলছি যে, ঝুঁকিটার কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক।’’
আরও পড়ুন: এবার আদালতেও থার্মাল স্ক্রিনিং, জরুরি মামলা ছাড়া শুনানি স্থগিতের নির্দেশ
এ হেন পরিস্থিতিতে সুর নরম করতে শুরু করে বাম-কংগ্রেসও। বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘রাজ্যে বহু পুরসভায় ভোট বকেয়া। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি বিচার করে কমিশন পুরভোট পিছিয়ে দিলে আমরা বিরোধিতা করব কেন? মানুষের জীবন সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’’ তবে এরই সঙ্গে করোনা পরিস্থিতিতে কী কী করণীয়, সেই নীতি দ্রুত রূপায়ণের দাবিও তুলেছেন তিনি। প্রদেশ কংগ্রেসের সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান প্রদীপ ভট্টাচার্যেরও বক্তব্য, ‘‘করোনা নিয়ে রাস্তাঘাটে, বাজারে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আমরাও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সভা-সমাবেশ বা জমায়েত বন্ধ কি না, তা এখনও পরিষ্কার নয়। বিপদের আশঙ্কায় রাজ্য সরকার যদি কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, প্রদেশ কংগ্রেস তা সমর্থন করবে।’’
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীও মনে করেন, সরকার যে সব পদক্ষেপ করেছে, তা জরুরি ছিল। আরও নানা কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ হওয়া প্রয়োজন বলে তাঁর মত। আর এই পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত কি না, সে প্রসঙ্গে বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘আগে তো মানুষের প্রাণ। মানুষ বাঁচলে তবে তো গণতন্ত্র। সুতরাং এই সাংঘাতিক সঙ্কটকে রোখার জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে একটু পিছিয়ে দেওয়া যেতেই পারে।’’ বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার যে নির্দেশিকাগুলো দিয়েছে, যেমন স্কুল-কলেজে ছুটি ঘোষণা করা, জমায়েত এড়িয়ে চলতে বলা, কোনও কোনও রাজ্যে জনবহুল এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে দেওয়া— এই সব পদক্ষেপগুলো যদি যুক্তিযুক্ত হয়, তা হলে এই মুহূর্তে ভোট হওয়ার কোনও অবকাশই নেই। কারণ ভোট মানেই জমায়েত।’’
আরও পড়ুন: ‘ভয় পাবেন না, প্রস্তুত থাকুন’, করোনা রুখতে সার্কের দেশগুলিকে বার্তা নরেন্দ্র মোদীর
ঠিক মুকুল রায়ের সুরেই বিশ্বনাথ চক্রবর্তীও বলছেন, ‘‘সমাবেশ ছাড়া নির্বাচন আমরা ভাবতেই পারি না। সমাবেশ শুধু রাজনৈতিক দলগুলো করবে, এমন নয়। ভোটের দিন বুথে ভোটারদের সমাবেশ হবে। ভোটকর্মীরা ভোটের আগের রাতে যেখানে গিয়ে থাকবেন, সেখানে সমাবেশ হবে। ভোটের দিন রাজনৈতিক দলগুলোর ক্যাম্পে অনেক লোক একসঙ্গে জমা হবেন। এ সব কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সুতরাং জননিরাপত্তার স্বার্থে আপাততা ভোট এড়িয়ে যাওয়াই ভাল।’’ অধ্যাপক চক্রবর্তীর দাবি, করোনা সঙ্কট যে আকার নিয়েছে, তা আসলে ‘মানব সভ্যতার সঙ্কট’। তাঁর কথায়, ‘‘পরিস্থিতি যে স্বাভাবিক নয়, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। সুতরাং অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মোকাবিলায় অস্বাভাবিক পদক্ষেপ করতে হতেই পারে। এই পরিস্থিতিতে ভোট করানো নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে বলে আমি মনে করি না।’’