অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।
এ যেন সাপের ছুঁচো গেলা অবস্থা। না যায় ফেলা, না যায় উগরানো! বছর ছেষট্টির মহেন্দ্র সিংহকে নিয়ে এমন দশাই হয়েছে কারা দফতরের কর্তাদের।
জেলে কখনও গন্ডগোল পাকাননি মহেন্দ্র। শান্ত মানুষ। সাতেপাঁচেও থাকেন না। কিন্তু, তার পরে ওই প্রৌঢ়ই এখন চিন্তায় ফেলে দিয়েছেন কারা আধিকারিকদের।
দেশ জুড়ে করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করার পর থেকেই আতঙ্কে জেল থেকে বেরনোর আর্জি জানাতে থাকেন বন্দিরা। তা নিয়ে দক্ষযজ্ঞ হয়ে যায় দমদম সেন্ট্রাল জেলে। প্রাণও যায় পাঁচ বন্দির। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টও বন্দিদের দাবি যুক্তিযুক্ত মনে করে। ফলে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ভিত্তিতে কলকাতা হাইকোর্ট বন্দিদের করোনার জন্য জেল থেকে সাময়িক মুক্তি (প্যারোল) মঞ্জুর করার সুপারিশ করে। কারা দফতর বিশেষ কমিটি তৈরি করে বন্দিদের প্যারোলে মুক্তির আবেদন বিচার করা শুরু করে।
আরও পড়ুন: আরও ১ মাস দেশ জুড়ে বন্ধ রাখা হোক স্কুল-কলেজ, মল, জমায়েত, সুপারিশ মন্ত্রিগোষ্ঠীর
আরও পড়ুন: লকডাউনের মধ্যে ভূমিকম্প, রাতে কাঁপল সিকিম, দিনে বাঁকুড়া
কারা দফতরের ওই কমিটিই ঠিক করে যে বন্দিদের সাজার মেয়াদ সাত বছর বা তার থেকে কম এবং যাঁদের জেলে রেকর্ড ভাল তাঁদের তিন মাসের জন্য প্যারোলে ছাড়া হবে। ওই কমিটিই নাম সুপারিশ করেছিল মহেন্দ্র সিংহের। বর্ধমান সংশোধনাগারে বন্দি মহেন্দ্র। তাঁকে বাদ দিয়ে আরও ২৬ জনকে প্যারোলে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় কারা দফতর। গত মঙ্গলবার সেই খবর পৌঁছয় বন্দিদের কাছে। রীতিমতো খুশির হাওয়া বয়ে যায় জেলের তার দেওয়ালের মধ্যে।
কিন্তু তার মধ্যেই কারা আধিকারিকদের চোখে পড়ে, নিজের ওয়ার্ডে এক কোণে চুপ করে বসে মহেন্দ্র। এক কারা আধিকারিক বলেন, ‘‘মহেন্দ্রকে প্রশ্ন করি কী হল? সবাই আনন্দ করছে জেল থেকে ছাড়া পাবে। আপনি তার মধ্যে এ রকম চুপচাপ কেন?” ওই কারা আধিকারিকের কথায়, ‘‘প্রশ্ন শুনেই কেঁদে ফেলেন মহেন্দ্র। হাত জোড় করে প্রায় পা ধরার উপক্রম করেন। বলতে থাকেন, স্যার আমাকে জেল থেকে তাড়িয়ে দেবেন না... বাইরে বেরোলে করোনায় মারা যাব।”
মহেন্দ্রর কথায় হকচকিয়ে যান কারা আধিকারিকরা। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় জেল সুপারের কাছে। বেশ খানিক ক্ষণ মহেন্দ্রর সঙ্গে কথা বলেন জেল সুপার। জানা যায়, উত্তর কলকাতার নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে থাকতেন তিনি। ২০১৪ সালে খুনের চেষ্টার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ। ২০১৭ সালের ১০ জুলাই বিচারভবনের ফাস্ট ট্র্যাক আদালতের অতিরিক্ত জেলা জজ তাঁকে সাত বছরের সশ্রম কারাবাসের সাজা দেন। তখন থেকেই বর্ধমান জেলে বন্দি তিনি।
কারা দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘জেল সুপারকে মহেন্দ্র জানিয়েছেন যে গ্রেফতার হওয়ার আগে নিমতলা স্ট্রিটের ফুটপাতেই থাকতেন তিনি। পোস্তায় মাল বাহকের কাজ করতেন। এখন জেল থেকে বেরোলে থাকার জায়গা পাবেন না। কারণ নিমতলায় ফুটপাতের যেখানে থাকতেন তা এত দিনে অন্য কেউ দখল করে নিয়েছেন। তা ছাড়া এখন দেশ জুড়ে লকডাউন। নিজের ডেরায় ফিরতে পারলেও, কাজ থাকবে না। খাবেন কী? তার উপর রয়েছে করোনার ভয়।” এক কারা আধিকারিককে মহেন্দ্র জানিয়েছেন, তিনি টিভিতে দেখেছেন এবং অন্য বন্দিদের কাছে শুনেছেন, যাঁদের বয়স ৬০ বছরের উপরে, তাঁদের করোনা হলে বাঁচার সম্ভাবনা কম। তাই এই অবস্থায় বাইরে বেরোলে করোনায় মারা যাবেন বলে আতঙ্কিত মহেন্দ্র।
গত ৩ এপ্রিল, বাকি ২৬ জন বন্দি জেল থেকে তিন মাসের প্যারোলে ছাড়া পেলেও, জেলেই থেকে গিয়েছেন মহেন্দ্র। এক কারা কর্তার কথায়, ‘‘এ বার মহেন্দ্রকে নিয়ে আমাদের ফ্যাসাদ। উপরওয়ালাদের জানাতে হচ্ছে কেন মহেন্দ্র জেল থেকে যাবেন না।” আপাতত মহেন্দ্র কারা দফতরকে লিখিত আবেদনে জানিয়েছেন যে, তিনি কী কারণে জেল থেকে বাইরে যেতে রাজি নন। সেই আবেদন এ বার খতিয়ে দেখবেন কারা দফতরের কর্তারা।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন,feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)