পাড়ার পুজো কর্তার মতোই এখন চরম ব্যস্ত তিনি। মাথা তোলার সময় নেই মানিক দাসের। পুজো কমিটির অন্যতম প্রধান কর্তা যে তিনি। আবার ‘বেদেনি’ নাটকেও গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্রে রয়েছেন। যে নাটক মঞ্চস্থ হবে দুগ্গা ঠাকুরের সামনে।
গিরিধারী কুমার ব্যস্ত গানের রিহার্সালে। মুক্তবেড়ি নামে তাঁদের যে বাউল দল রয়েছে, সেখানে ইতিমধ্যে নজর কেড়েছেন গিরিধারী। পুজোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এ বারও নিজেকে প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ।
মার্শাল আর্টের শিল্পীরাও ব্যস্ত যে যাঁর মতো কসরত করতে। পুজোর আগেই নানা অনুষ্ঠানের বায়না পেয়ে গিয়েছেন। তা ছাড়া তাঁদের নিজেদের অনুষ্ঠানও রয়েছে পুজোতে।
মানিক, গিরিধারীরা হইহই করে পুজোর চার দিন মেতে থাকেন বটে। কিন্তু কাশফুল, শিউলির গন্ধ, পুজোর কেনাকাটা, পরিবারকে নিয়ে হইহই করে ঠাকুর দেখা— এ সব কিন্তু নেই এঁদের জীবনে। কারণ এঁরা প্রত্যেকেই দমদম সেন্ট্রাল জেলের কয়েদি। কেউ নিজের স্ত্রীকে খুন করেছেন, কেউ আবার বন্ধুদের সঙ্গে দলে পড়ে কাউকে খুন করে সাজা খাটছেন। কারও যাবজ্জীবন, কারও দশ বছরের সাজা হয়েছে। কিন্তু জেলের মধ্যে থেকেও পুজোর চার দিন যেন মুক্তির আনন্দ। কারণ স্বামী বিবেকানন্দর নামাঙ্কিত হলঘরে ওই ক’দিন আর সবার মতোই দশভুজার আরাধনায় মেতে ওঠেন ওঁরা।
পুজোমণ্ডপের সাজসজ্জা থেকে যাবতীয় কাজ করেন কয়েদিরা মিলেমিশে। এমনি সময় আলাদা কুঠুরিতে থাকলেও পুজোর চার দিন মহিলা কয়েদিরাও হাত মেলান। নিয়ম মেনে সব উপচার সাজিয়ে রাখেন। রোজ বিকেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এই পুজোকে পূর্ণতা দেয়। চার দিন পেটপুজোও মন্দ হয় না। কুমড়োর ঘন্ট, ডালভাতের একঘেয়ে মেনুতে ঢুকে পড়ে খাসির মাংস, মাছের কালিয়া, ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেনের মতো পদ। দমদম সেন্ট্রাল জেলের সুপার নবীন সাহা বলছিলেন, ‘‘আমরা চেষ্টা করি পুজোর সময়ে কিছুটা হলেও ওদের একটু আনন্দ দিতে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ধুনুচি নাচ, শঙ্খধ্বনি প্রতিযোগিতাও হয়। পাড়ার পুজোয় যেমন সবাই মিলে হইহই করে এখানেও সে রকমই হয়।’’ মানিকও বললেন, ‘‘বাজেট করে আমরা সুপার স্যারকে বলি। উনিই সব ব্যবস্থা করে দেন।’’ পাশে বসা সুবীর মণ্ডল যোগ করলেন, ‘‘নিজেদের ব্যস্ত না রাখলে তো বাঁচতে পারব না।’’
চারটে দিনই অক্সিজেন। নইলে বছরের বাকি সময়টা জু়ড়ে তো দমদম বা আলিপুর জেলের গরাদের ভিতর স্যাঁতস্যাঁতে একঘেয়ে জীবন। থালা হাতে খাবারের লাইনে দাঁড়ানো। ঘণ্টি বাজার সঙ্গে সঙ্গে নিয়মমাফিক কাজ। তাই সপ্তমী থেকে দশমীর ঢাকের আওয়াজ, ধুপ-ধুনোর গন্ধ, শঙ্খ-উলুধ্বনি কিছুটা হলেও রং নিয়ে আসে ফ্যাকাসে দিনগুলোতে। মনে পড়ে পুরনো দিনের কথা।
স্ত্রী-কে খুনের অপরাধে জেল খাটা মানিক ছলছল চোখে বলছিলেন, ‘‘ছেলেটা যখন ছোট ছিল, বাপ-ছেলেতে মিলে ঠাকুর দেখতে যেতাম। আমি তো এই জেলে দুর্গাপুজো নিয়ে মেতে থাকি। ছেলেটা সেই ছোট থেকে একেবারে একা।’’ বিএসএফ-এ চাকরি করতেন সুবীর। পড়াশোনা বা কাজের সূত্রে বেশির ভাগ সময় বাইরেই কাটিয়েছেন। স্ত্রীকে খুনের অপরাধে ১৪ বছর জেল খেটে ফেলেছেন পুজো কমিটির গুরুত্বপূর্ণ এই সদস্য। বলছিলেন, ‘‘উৎসবের দিনগুলোতে বেশি বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে। ছোটবেলার মতো মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে ঠাকুর দেখতে ইচ্ছে করে।’’
পুজোর দিনগুলো তাই আনন্দের যেমন, কষ্টেরও কম নয়।