প্রতীকী ছবি।
বই হাতে ক্লাসে ঢুকছেন শিক্ষক। রীতি মেনে উঠেও দাঁড়াচ্ছে পড়ুয়ারা। ক্লাসে ঢুকে শিক্ষক সব ছাত্রছাত্রীকে বসতে বললেও নিজে অবশ্য ঠায় দাঁড়িয়ে থাকছেন। পড়াতে পড়াতে পুরো সময়টা শুধু দাঁড়িয়ে আর হাঁটাচলা করেই কাটাতে হচ্ছে তাঁকে। কারণ, ক্লাসে তাঁর বসার জন্য নেই কোনও চেয়ার!
বেশ কিছু বেসরকারি স্কুলে এমনটাই দস্তুর। তবে এ বার সরকার পোষিত এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের শ্রেণিকক্ষে খুব তাড়াতাড়ি এই একই ছবি দেখা যেতে চলেছে। কারণ, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য বসার চেয়ার নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা স্কুলশিক্ষা দফতর। ওই জেলায় প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক মিলিয়ে প্রায় ছ’হাজার স্কুলে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই এই নিয়ম চালু হতে চলেছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা স্কুল পরিদর্শক (ডিআই) নজরুল হক সিপাই বলেন, ‘‘একটি ক্লাসে পিছনের সারিতে যে পড়ুয়ারা বসে থাকে তাদের কাছে যেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা পৌঁছতে পারেন, তাই চেয়ার রাখা হবে না। তবে টেবিল থাকবে। দ্রুত এই বিষয়ে নির্দেশিকা জারি করা হবে।’’ কেন এই সিদ্ধান্ত? নজরুলবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘চেয়ার থাকলে বসার ইচ্ছা হতে পারে। কিন্তু টিচিং-লার্নিং পদ্ধতি ঠিক হতে গেলে সকল পড়ুয়ার কাছে শিক্ষকদের পৌঁছতে হবে। তাই এই উদ্যোগ।’’
ডিআই জানাচ্ছেন, সম্প্রতি স্কুল পরিদর্শনে দেখা গিয়েছে যে, শিক্ষকদের একাংশ ক্লাসে এক জায়গায় বসে পড়ান। ফলে সবসময় তাঁরা কী পড়াচ্ছেন, তা শেষ প্রান্তের পড়ুয়ার কাছে পৌঁছয় না। সে ক্ষেত্রে চেয়ার না থাকলে বসার জায়গা থাকবে না। ফলে শিক্ষকেরা দু’টি সারির বেঞ্চের মধ্যে ঢুকেও পড়ুয়াদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারবেন। ৪০ মিনিটের এক একটি ক্লাসের মধ্যে ৩০ মিনিট পড়ানো এবং ১০ মিনিট পড়ুয়াদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য রাখা হবে। একই সঙ্গে এই দু’টি নির্দেশ ওই জেলার সবক’টি স্কুলে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন ডিআই।
তবে ক্লাসে চেয়ার ‘ব্রাত্য’ করার এই সিদ্ধান্তের কথা জানাজানি হতেই তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে শিক্ষামহলে। স্কুলশিক্ষা কমিশনারেটের এক কর্তা বলেন, ‘‘বিষয়টি সংশ্লিষ্ট স্কুলের হাতে ছাড়লেই ভাল হত। এর মধ্যে ডিআই-এর হস্তক্ষেপ না করাই ভাল। আইনত এই ক্ষমতা ডিআই-এর আছে কি না, তা-ও দেখার বিষয়।’’ তাঁর মতে, কী ভাবে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হবে, তা বাইরে থেকে চাপানো উচিত নয়। তাই ক্লাসে চেয়ার থাকা বা না-থাকার মতো বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। নজরুলবাবু অবশ্য জানাচ্ছেন, ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল সার্ভিস রুল’-এ ডিআই-এর ‘কোড অব কন্ডাক্টে’ এই ক্ষমতার কথা বলা আছে। সেই নিয়মানুযায়ী, নির্দেশ দেওয়ার পরে তা সংশ্লিষ্ট জেলা শাসক, স্কুলশিক্ষা কমিশনার ও স্কুলশিক্ষা সচিবকে তার প্রতিলিপি পাঠাতে হবে। ‘‘আমি বেআইনি কিছু করছি না। সকলের ভালোর জন্যেই এই পদক্ষেপ’’—বলছেন নজরুলবাবু।
এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্য একটি জেলার ডিআই বলছেন, ‘‘শিক্ষকেরা নিজে থেকে এ সব করলে ভাল হত। ডিআই জোর করে চাপিয়ে দিলে সেটা ভাল দেখায় না।’’ আর এক ডিআইয়ের মন্তব্য, ‘‘ভাল উদ্যোগ। গোটা রাজ্যেই এই পদ্ধতি চালু হওয়া প্রয়োজন।’’
চেয়ার-সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে কলকাতার আইসিএসই বোর্ডের একটি স্কুলের অধিকর্তা অবশ্য বলছেন, ‘‘শুনেছি কিছু স্কুলে এই পদ্ধতি চালু আছে। তবে আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই ব্যবস্থার সঙ্গে একেবারে একমত নই। শিক্ষকেরা বসবেন না কি দাঁড়িয়ে পড়াবেন, সেটা তাঁদের ব্যাপার। এটা চাপিয়ে দেওয়া যায় না।’’ গত কয়েক বছর ধরে লখনউ ও বর্তমানে আগরার বেসরকারি স্কুলে পড়াচ্ছেন চিত্রা ঘোষ নামে এক শিক্ষিকা। তিনি বলছেন, ‘‘এখানকার স্কুলে দাঁড়িয়ে পড়ানোটাই নিয়ম। কিন্তু চেয়ারটা অন্তত থাকে।’’ তবে এ ভাবে দীর্ঘদিন দাঁড়িয়ে থাকার কারণে বর্তমানে পায়ের সমস্যা দেখা দিয়েছে বলেও জানাচ্ছেন তিনি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডিআই অবশ্য জানিয়েছেন, বেশি ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে যে সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার অসুবিধা রয়েছে, তাঁদের জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা থাকবে।