তৌসিফ বিতর্কের প্রতিবাদে মাহফুজ় আলির কার্টুন (বাঁ-দিকে)। তৌসিফের এই ছবি নিয়েই বিতর্ক।
তিনি কি সত্যি ‘অপমানিত’? তাঁর ‘অপমানে’ ভক্তকুল কি সত্যিই ব্যথিত? নাকি চিত্রশিল্পী আদতে এক জন অহিন্দু, সেটাই গোলযোগের হেতু?
চিত্রশিল্পীর পাশে অনেকেই। তাঁর সমর্থনে অনেকেই সরব। তবু শিবরাত্রিতে তৌসিফ হকের আঁকা শিবের ছবি নিয়ে বিতর্ক প্রশ্নগুলো ছুড়ে দিচ্ছে। গোটা বিষয়টিতে বিরক্ত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বা পুরাণ-মহাকাব্য বিশারদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী। কার্যত এক সুরেই তাঁরা বলছেন, ‘‘এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি। বাঙালি এমন অসহিষ্ণু ছিল না।’’
শিবঠাকুরের আপন দেশে (পড়ুন ফেসবুকে), আইনকানুন অবশ্য সর্বনেশে! বিতর্ক এবং ট্রোলিংয়ের জেরে তৌসিফের সেই পোস্ট-সহ তাঁর প্রোফাইল এখন ‘অদৃশ্য’। তবে ছবিটি ভাইরাল। পেশাদার শিল্পী তৌসিফ নানা বিষয়ের ছবি আঁকেন। বিবেকানন্দকে নিয়ে বইয়ের প্রচ্ছদও করেছেন। সেই বইয়ের লেখক বিশ্বজিৎ রায়ই ফেসবুকে লিখেছেন, বিবেকানন্দ মাঝে মাঝেই গোঁড়া হিন্দুদের নিয়ে যে ভাবে রঙ্গ করতেন তাঁর নামেও হিন্দুত্ববাদীদের রিপোর্ট করা উচিত! এ দিন অবশ্য তৌসিফের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা যায়নি।
যামিনী রায়ের আঁকা নাদুসনুদুস শিব।
নন্দলাল বসু, যামিনী রায়ের ক্যানভাসেও শিবের নাদুসনুদুস সুখী অবয়ব। তৌসিফ ফেসবুকেই লিখেছিলেন, ‘‘সিক্স প্যাক পেশিবহুল শিব আদৌ বাঙালির শিব নন। বাঙালির শিবঠাকুর মাসলওয়ালা মস্তান নন, বরং শান্ত নম্র, নাদুসনুদুস…।’’ তাতেই হিন্দু ভাবাবেগ জখম হওয়ার ধুয়ো তুলেছেন কোনও কোনও স্বঘোষিত ‘শিবভক্ত’। এমনকি আরবি নামধারী কেউ কোন শিব বাঙালির পুজ্য ঠিক করে দিচ্ছেন ধুয়ো তুলেও দেখা যাচ্ছে অশান্তি সৃষ্টির ইন্ধন। বিষয়টিতে স্তম্ভিত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ‘‘বাঙালির ঠাকুরদেবতা তো সবার! নজরুলের অসামান্য সব শ্যামাসঙ্গীত আমরা ভুলে গিয়েছি? আর লালনের গানগুলো?’’— প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন তিনি। তাঁর মতে, ‘‘দেবতাদের নিয়ে রঙ্গব্যঙ্গের পরম্পরাও অনেক দিনের। মঙ্গলকাব্য থেকেই চলছে।’’ অন্নদামঙ্গলের শিবকে ব্যাজস্তুতির আদলে বলা হয়েছে, কোনও গুণ নাই তার কপালে আগুন বা কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠ ভরা বিষ। আগমনি গানের উমার বর শিব, ঘটিবাটি বেচে নেশা করছেন। বাঙালি শিবের ‘ধুতুরা পানে আঁখি ঢুলু-ঢুল, কালী ধ্যানে ব্যাঘ্রচর্ম খসিয়া খসিয়া পড়িছে’!
আরও পড়ুন: সমাবর্তনে যাব বারাসতে, রাজ্যপালের টুইটে জল্পনা
“এ সবই দেবতার মানবায়নের ধারা। এটাই বাঙালির পরম্পরা,” বলছেন নৃসিংহবাবুও। তাঁর কথায়, ‘‘এমনিতে যে যেমন খুশি শিবের পুজো করতেই পারে, কিন্তু চিরকেলে ভারতের দেবতারা অনেকটা ক্যালেন্ডারের ঠাকুর। কেউই উৎকট পেশিবহুল নন।’’ জিমচর্চিত ঢেউখেলানো পেশির শিব অবয়ব খানিক সাম্প্রতিক কল্পনা বলেই নৃসিংহবাবুর ধারণা। ফেসবুকে শিবকে নিয়ে এই বিবাদের মধ্যে এক ধরনের উগ্র হিন্দুয়ানি এবং পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়ার প্রবণতা লক্ষ করছেন অনেকেই।
তবে শিবের আসল-নকল নিয়ে গোমড়ামুখো কান্নাকাটি এবং প্রোফাইল রিপোর্ট করার রক্তচক্ষু জারি থাকলেও সরস বাঙালির সৃষ্টিশীলতা অদম্য। এ দিনই কার্টুনিস্ট মাহফুজ় আলির ছবিতেই ছোট্টখাট্টো ভুঁড়িদার শিবের সঙ্গে অতিকায় ‘হি-ম্যান’ মার্কা শিবের টক্কর নির্মল হাস্যরস ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাঙালির পুরনো গানের শিবও ঝগড়াঝাঁটির পরোয়া করেন না, ‘বেলপাতা নেয় মাথা পেতে গাল বাজালে হয় খুশি, মান অপমান সমান যে তার, তার কাছে নয় কেউ দোষী!’
এমন সদাপ্রসন্ন দেবতার অপমানের ঠিকাদার কোন অর্বাচীন? তারা কি সত্যি বাঙালি? এই প্রশ্নেও রসিক বাঙালি দিনভর হেসে খুন হচ্ছে!