কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির অদূরে বিক্ষোভ চাকরিপ্রার্থীদের। —ফাইল চিত্র।
পথেঘাটে বিক্ষোভে পুলিশি ধরপাকড় নতুন নয়। সেই গ্রেফতারির পরেই ব্যক্তিগত বন্ডে ছেড়েও দেওয়া হয়। কিন্তু শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের অদূরে বিক্ষোভরত ৫৯ জন চাকরিপ্রার্থীর বিরুদ্ধে জামিনঅযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করেছিল কলকাতা পুলিশ। শনিবার আদালতে গিয়ে তাঁদের হেফাজতে নেওয়ার আর্জিও জানিয়েছিল তারা। তবে সেই আর্জি টেকেনি কোর্টে। ৫৫ জনকে জামিনে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন আলিপুর আদালতের বিচারক। চার জনের সোমবার পর্যন্ত জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
জামিনের পরেই অবশ্য এই বিতর্কে জল পড়েনি। দীর্ঘদিন ধরে চাকরির আশায় থাকা আন্দোলনকারীদের জামিনঅযোগ্য ধারায় অভিযুক্ত করে লালবাজার কোন ‘অপরাধের’ তদন্ত করতে চাইছিল, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। পুলিশের যুক্তি, আন্দোলনকারীরা মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির নিরাপত্তা বলয় ভেঙেছেন। উর্দিধারীদের মারধরও করেছেন। সে সবের পরিকল্পনা জানতেই হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন ছিল।
তবে পুলিশের এই যুক্তি মানতে নারাজ আইনজীবী এবং পুলিশকর্তাদের একাংশ। তাঁদের দাবি, জামিনঅযোগ্য ধারায় ফেঁসে গেলে কোনও চাকরি পাওয়া যাবে না— এমন ভয় দেখানোর জন্যই এই কাজ করেছে পুলিশ। প্রসঙ্গত, চাকরিপ্রার্থীদের একের পর এক মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগে ইতিমধ্যে কলকাতা হাই কোর্টে মামলাও হয়েছে। শুক্রবার উচ্চ প্রাথমিকের বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি থেকে অন্তত দেড়শো মিটার দূরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। সে সময় পুলিশ তাঁদের মধ্যে ৫৫ জন মহিলা-সহ মোট ৫৯ জনকে গ্রেফতার করে এবং লালবাজারে নিয়ে যায়। এ ধরনের মামলায় লালবাজার থেকেই জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু শুক্রবার তা হয়নি। রাতভর তাঁদের লক-আপে আটকে রাখা হয়। শনিবার আলিপুর কোর্টে হাজির করানো হয় ধৃতদের। কোর্টে মুখ্য সরকারি কৌঁসুলি দাবি করেন যে বিক্ষোভকে ঢাল তৈরি করে আইনশৃঙ্খলা নষ্টের চেষ্টা হয়েছিল। ওই এলাকায় দু’জন ‘ভিআইপি’-ও থাকেন। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের মনে হয়েছে যে জ়েড ক্যাটেগরির নিরাপত্তা বলয় ভেঙে অপরাধ ঘটানোর পরিকল্পনাও ছিল। হাজরা মোড়ে বিক্ষোভের কথা থাকলেও বিক্ষোভকারীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে গোলমাল পাকিয়েছেন।সরকারি কৌঁসুলির বক্তব্য শুনে বিচারক তদন্তকারী অফিসারকে প্রশ্ন করেন যে পুলিশ হেফাজতের কী প্রয়োজন? তদন্তকারী অফিসার বলেন, ‘‘ওই রাস্তায় মুখ্যমন্ত্রী থাকেন। আন্দোলনকারীরা ৯ জন পুলিশকর্মীকে জখমও করেছেন। অপরাধ সংগঠিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ওই পরিকল্পনা এবং ষড়যন্ত্র কী ভাবে হয়েছিল তা জানার জন্যই হেফাজতের প্রয়োজন।" যদিও ধৃতদের আইনজীবী ফিরদৌস শামিম বলেন, ‘‘পুলিশের উপর কোনও হামলা হয়নি। পুলিশই আন্দোলনকারীদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছে। তা সংবাদমাধ্যমে দেখা গিয়েছে। চাকরিপ্রার্থী আন্দোলনকারীদের জীবনে অপরাধের দাগ দেওয়ার চেষ্টা করে ভয় দেখানো হচ্ছে।’’ এর পরেই বিচারক ৫৫ জন মহিলা চাকরিপ্রার্থীকে ২ হাজার টাকার বন্ডে জামিন দেন। তাঁরা কালীঘাট থানা এলাকায় প্রবেশও করতে পারবেন না। চার জন পুরুষ বিক্ষোভকারীকে সোমবার পর্যন্ত জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। এক রাত লক আপে থাকার যন্ত্রণা এ দিন সংবাদমাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন চাকরিপ্রার্থীদের অনেকে। এক মহিলা চাকরিপ্রার্থী বলেন, “বাড়ির লোককে খবর দিতে পারিনি। বাড়িতে ছোট সন্তান আছে। তাকে নিয়েও চিন্তায় ছিলাম। লক আপে নোংরা কম্বল বিছিয়ে মাটিতে শুতে হয়েছে। এদিন সকালে দুটো রুটি আর আলুর তরকারি খেতে দিয়েছিল পুলিশ। তার পর সারাদিন আর কিছু খেতে পাইনি। বিকেলে অনেক চেষ্টার পর একটা করে বিস্কুটের ছোট প্যাকেট জুটেছে।”
এই ঘটনায় রাজনৈতিক তরজাও শুরু হয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘‘ভাইপো চুরির দায়ে ধরা পড়লে মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে দরবার করতে পারেন। চাকরি-প্রার্থীরা, যাঁদের চাকরি চুরি হয়েছে, নিলাম হয়েছে, তাঁরা সুষ্ঠু নিয়োগের দাবিতে মিছিল করলে তাঁদের গ্রেফতার করতে হবে! যাঁদের স্কুলে গিয়ে, মাদ্রাসায় গিয়ে পড়ানোর কথা, তাঁদের জেলে পাঠাচ্ছে। যাঁদের জেলে যাওয়ার কথা, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গিয়ে বৈঠক করছেন।’’ রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে কেউ বিক্ষোভ করলে পুলিশ নিরাপত্তার কারণে কাউকে গ্রেফতার করতেই পারে। কিন্তু মেধাযুক্ত, যোগ্য, প্রতারিত এবং মুখ্যমন্ত্রীর কারণে চাকরি থেকে বঞ্চিত হওয়া চাকরি-প্রার্থীরা মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হওয়ায় পুলিশ জামিনঅযোগ্য ধারা দিয়ে আবার প্রমাণ করল তৃণমূল কংগ্রেসের মতো অসংবেদনশীল, প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকার ভারতে আর দুটো নেই।’’ তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন নিয়ে কিছু বলার নেই। কিন্তু কারা তাঁদের মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির দিকে লেলিয়ে দিল? এর পিছনে কোনও উদ্দেশ্য আছে কি? এই প্রশ্নের উত্তরগুলো তো তদন্তাধীন। তাই পুলিশ মামলা দিয়েছে।”