প্রতীকী ছবি।
গুজরাতের পথে হাঁটুক পশ্চিমবঙ্গ-সহ সব রাজ্য। প্রসবের পরে প্রসূতির রক্তক্ষরণ বন্ধের ওষুধের (অক্সিটোসিন) ব্যবহার নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের নতুন নির্দেশিকার মূল সুর এটাই। কিন্তু এ রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা সেই পরামর্শের সঙ্গে পুরোপুরি সহমত হতে পারছেন না।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে প্রতিটি রাজ্যে যে-চিঠি পাঠানো হয়েছে, তাতে ‘ফিজিয়োলজিক্যাল কর্ড ক্ল্যাম্পিং’ প্রক্রিয়ায় বদল আনতে বলা হয়েছে। মোদ্দা কথা, প্রসবের পরে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গর্ভস্থ ‘প্লাসেন্টা’ বা ফুল বেরোনোর আগে পর্যন্ত চিকিৎসকদের অপেক্ষা করতে হবে। গর্ভস্থ ফুল স্বাভাবিক ভাবে বেরোনোর পরেই চিকিৎসকদের নাড়ি কাটার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তত ক্ষণ প্রসূতির রক্তক্ষরণ বন্ধে চিকিৎসকেরা যে-অক্সিটোসিন ওষুধ দেন, তা থেকে বিরত থাকতে হবে।
কেন্দ্রের এই ‘পরামর্শের’ সঙ্গে একমত হতে পারছেন না স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একাংশ। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের অনেকে জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা মেনে এখন প্রসবের দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে কর্ড কাটা হয়। অক্সিটোসিন দেওয়া হয় ওই সময়ের মধ্যেই। বস্তুত, অক্সিটোসিন দিলে গর্ভস্থ ফুল বেরিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্লাসেন্টা বেরোনো পর্যন্ত অপেক্ষা করলে রক্তক্ষরণের জেরে প্রসূতির বিপদ হতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসকদের একাংশ। কেন্দ্রের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, গর্ভস্থ ফুল স্বাভাবিক ভাবে বেরিয়ে আসতে সাধারণত পাঁচ থেকে পনেরো মিনিট লাগে। অনেক চিকিৎসকের বক্তব্য, অত ক্ষণ অক্সিটোসিন না-দিয়ে ফেলে রাখার অর্থ ঝুঁকি নেওয়া।
কেন্দ্রের প্রস্তাবের ধাত্রীভূমি হল গুজরাত। সেখানে ‘এভিডেন্স ট্রায়ালে’ এক হাজারেরও বেশি মহিলার প্রসব এই প্রক্রিয়ায় হওয়ায় সুফল মিলেছে বলে নির্দেশিকায় জানানো হয়েছে। নবজাতকদের রক্তাল্পতায় ভোগার আশঙ্কা কমেছে। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা বেড়েছে। তাদের হৃৎস্পন্দন এবং রক্তচাপের পরিস্থিতিও বেশ ভাল।
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রধান আরতি বিশ্বাস জানান, একটা সময় ছিল, যখন প্রসবের পরেই নাড়ি কাটা হত। তাতে ক্ষতি হত নবজাতকের। সেই জন্য মায়ের রক্ত কর্ডের মাধ্যমে নবজাতকের শরীরে আসা যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখনই নাড়ি কাটা হয়। সেটাও ২-৩ মিনিটের বেশি নয়। সরকারি হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধানের কথায়, ‘‘প্রসূতি-মৃত্যুর একটি বড় কারণ রক্তক্ষরণ। অক্সিটোসিন তা প্রতিহত করে। কেন্দ্রের প্রস্তাবটি নতুন বিষয়। খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের উদ্দেশ্য প্রসূতি ও নবজাতক, উভয়েরই মৃত্যুর হার কমানো।’’
একটি বেসরকারি হাসপাতালের স্ত্রীরোগ চিকিৎসক মোনাজাতুর রহমান বলেন, ‘‘মায়ের থেকে নবজাতকের শরীরে যাতে বেশি রক্ত যায়, সেই জন্য গর্ভস্থ ফুল স্বাভাবিক নিয়মে বেরোনো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু রক্তক্ষরণের জন্য মায়ের বিপদ হলে কী হবে? আমাদের দেশে তো দুই-তৃতীয়াংশ মহিলাই রক্তাল্পতায় ভোগেন।’’
বুধবার রাজ্যসভায় এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তৃণমূল সাংসদ শান্তনু সেন বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় গুজরাতে মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর হার বেশি। খামোকা গুজরাত মডেল মানতে যাব কেন!’’
স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কেন্দ্র যে-নতুন প্রস্তাব পাঠিয়েছে, তা আমাদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা পর্যালোচনা করবেন। তার পরেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’’