আলিমুদ্দিনে সাংবাদিক বৈঠকে সূর্যকান্ত মিশ্র। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।
না মানলে বিপদ ছিল। মেনেও বিপদ হয়েছে! এ বারের বিধানসভা ভোটে বামেদের সার্বিক পরাজয়ের মধ্যে আরও বেশি ধাক্কা খেয়ে অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছে বাম শরিকদের!
অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে বাম শরিক নেতারা এখন দুষছেন কংগ্রেসকে। তাঁদের ক্ষোভ, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে তাঁদের কোনও লাভই হয়নি। বহু ক্ষেত্রে কংগ্রেসের ভোট নাকি তাঁরা পাননি। আবার যেখানে জোটের মধ্যে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই’ হয়েছে, সেখানে বড় শরিক সিপিএমের কর্মী-সমর্থকেরাও ফরওয়ার্ড ব্লক বা আরএসপি-র বদলে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিপর্যয়ের সময় বলে সিপিএম নেতৃত্ব এখনও পর্যন্ত শরিকদের কথা মুখোমুখি বসে শুনেছেন। কিন্তু নিজেদের দলীয় স্তর থেকে সিপিএম নেতৃত্ব যুক্তি দিচ্ছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না থাকলে ছোট বামদলগুলির অবস্থা আরও সঙ্গিন হতো!
এ বার আরএসপি তিনটি, ফব দু’টি এবং সিপিআই একটি করে আসন পেয়েছে। ভোটের হিসেবে সিপিআই পেয়েছে ১.৫%, ফব ২.৮% এবং আরএসপি ১.৭%। দু’বছর আগে লোকসভা ভোটে এই হার ছিল সিপিআইয়ের ২.৩৬%, ফব-র ২.১৭% এবং আরএসপি-র ২.৪৬%। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে গিয়ে বহু বছর ধরে লড়ে-আসা বেশ কিছু আসন এ বার ছেড়ে দিতে হয়েছিল শরিকদের। তা নিয়ে তাদের ক্ষোভ ছিলই। ভোটের ফলে ধাক্কা খেয়ে হতাশা স্বভাবতই আরও বেড়েছে। অন্যান্য বার সিপিএমের উপরে ভর করে বহু আসন তাদের জিততে হতো বলে কৃতজ্ঞতাবশত রাগের কথাও চেপে রাখত তারা। এ বার ‘বাইরের শক্তি’ কংগ্রেস উপস্থিত থাকায় তাদের উপরে ক্ষোভ উগরে দেওয়া সহজ হয়ে গিয়েছে!
সিপিএম নেতারা অবশ্য দলের অন্দরে বলছেন, কংগ্রেসকে নিয়ে শরিকেরা আপত্তি তুলেছিল প্রথমেই। কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পছন্দ হচ্ছে না বলে আলাদা লড়ার ঝুঁকি কোনও শরিক দলই নেয়নি। কারণ, নিজেদের সংগঠনের জোর তাদের বিলক্ষণ জানা ছিল! এখন কংগ্রেসকে দুষলেও শরিকদের নিজেদের শক্তি যে এমনিতেই ক্ষয়িষ্ণু, সেই সত্যকে চেপে রাখার উপায় নেই বলেই জোট শিবিরের অধিকাংশের ধারণা। তাঁরা উদাহরণ দিচ্ছেন, দিনহাটা বা নলহাটি তো ফ ব নিজের জোরেই জিতে আসতে পারত! যেখানে তারা আগে চতুর্মুখী লড়াইয়েও জিতেছে। এখন হেরে গিয়ে দোষারোপের মধ্যেই স্পষ্ট, কংগ্রেসের ভোটের উপরে তাদের ‘নির্ভর’ করতে হচ্ছিল! সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, ‘‘এই ভোটে অনেক হিসেবই ওলট-পালট হয়েছে। যারা বরাবর নিজেদের ‘কমিটেড’ ভোটে জেতে, সেই এসইউসি একটাও আসন পায়নি। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না থাকলে বাম শরিকদের এই সামান্য আসনও জুটত কি না, নিশ্চিত করে বলা যায় কি?’’
শরিক নেতারা যদিও সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বের মত উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে তাঁদের ফল খারাপ হয়েছে। আগে কংগ্রেসের সঙ্গে ঘর করার অভিজ্ঞতা মাথায় থাকায় সিপিআইয়ের ব্যথাও বেশি। দলের রাজ্য কর্ম-পরিষদের বৈঠকে শনিবার কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে সিপিআই নেতৃত্ব প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। জবাবে তাঁরা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সিপিএম কোনও শরিকের মতের অপেক্ষা করেনি। তৃণমূল-বিরোধী ভোট যাতে ভাগ না হয়, তা ভেবেই বাধ্য হয়ে ওই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়েছে। বৈঠকের পরে দলের নেতা ম়ঞ্জুকুমার মজুমদার বলেন, ‘‘১৯৭২-এ কংগ্রেসের সঙ্গে গিয়ে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা আজও পূরণ হয়নি। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করলে লাভের তুলনায় ক্ষতিই বেশি, সে কথা এখন সবাই বুঝতে পারছেন!’’
প্রায় একই সুরে আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদক ক্ষিতি গোস্বামীর বক্তব্য, ‘‘মুর্শিদাবাদ জেলায় যে সব আসনে আমাদের সঙ্গে কংগ্রেসের বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই হয়েছে, সেখানে সিপিএম তাদের ভোট কংগ্রেসকে দিয়েছে। অথচ যেখানে তৃণমূলের সঙ্গে আমাদের সরাসরি লড়াই হয়েছে, সেখানে কংগ্রেসের ভোট আমরা পাইনি।’’ ফব-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নরেন চট্টোপাধ্যায় উদাহরণ দিচ্ছেন, ‘‘বীরভূমের নলহাটির যে সব এলাকায় কংগ্রেস শক্তিশালী, সেখানে আমরা ভোট পাইনি। ফলে, তৃণমূলের কাছে হেরেছি। কিন্তু হাঁসনে আমাদের ভোটে কংগ্রেস জিতেছে।’’ দিনহাটাতেও একই ঘটনা ঘটেছে বলে তাঁর অভিযোগ। নরেনবাবুর মন্তব্য, ‘‘যে ভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট চাপিয়ে দিয়ে তা মানুষের জোট বলা হল, মানুষই তা মেনে নেয়নি!’’
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র অবশ্য এ দিনই বলেছেন, কংগ্রেসের ভোট বামেরা পেয়েছি কি না, তা নিয়ে অকারণে অবিশ্বাস সৃষ্টি করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক জোট থাকায় লোকসভার তুলনায় তৃণমূলের সঙ্গে ব্যবধান কমানো গিয়েছে। সূর্যবাবুর কথায়, ‘‘কংগ্রেস সমর্থকেরা ভোট দিয়েছেন কি দেননি, এটা কে কী ভাবে হিসাব করবে! এ ভাবে আন্দাজে কোনও সামগ্রিক সিদ্ধান্ত করে ফেলা উচিত নয়।’’