চিকিৎসকদের অনশন - মঞ্চের সামনে সমাবেশ। ধর্মতলায়। —নিজস্ব চিত্র।
অষ্টমী গড়িয়ে নবমী তিথি পড়ে যাওয়ার বিকালে অনশন-মঞ্চের সামনে সমাবেশে সকলকে শামিল হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেই সমাবেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল সিপিএম। অবশ্যই দলের পতাকা দূরে রেখে। কিন্তু ধর্মতলা চত্বরে সিপিএম ও বামফ্রন্টের রাজ্য নেতৃত্ব উপস্থিত হতেই ঘোষণা শুরু হয়েছিল, আন্দোলনকে ‘হাইজ্যাক’ করার কোনও চেষ্টা যাতে না হয়, সেই অনুরোধ করা হচ্ছে! পরিস্থিতি বিড়ম্বনাদায়ক হয়ে উঠতে পারে আন্দাজ করে বাম নেতৃত্ব সেখানে বেশি ক্ষণ দাঁড়াননি।
পুজোর মধ্যে মণ্ডপের সঙ্গে প্রায় পাল্লা টানার মতো জনসমাগমের দিনে ধর্মতলার ওই ঘটনা যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে বাম শিবিরে। সিপিএম এবং বামফ্রন্টের তরফে আনুষ্ঠানিক সমর্থনের আহ্বান থাকায় বাম কর্মী-সমর্থকদের অনেকেই কয়েক ঘণ্টার নোটিসে ধর্মতলার সমাবেশে এসেছিলেন। তাঁদের প্রশ্ন, যাঁরা সকলকে শামিল হওয়ার আহ্বান জানালেন, তাঁরাই সংহতি জানাতে আসা অনেকের জন্য ‘অপ্রীতিকর’ পরিস্থিতি তৈরি করলেন! এ ভাবে চললে আন্দোলনের পরিধি বড় হবে কী করে? কলকাতা জেলা সিপিআইয়ের এক নেতার কথায়, ‘‘দলীয় পতাকা নিয়ে কেউ আসেননি, বক্তৃতা করতেও আসেননি। নাগরিক হিসেবে রাজনৈতিক কর্মী বা ব্যক্তিত্বেরা তো কোথাও প্রতিবাদে সংহতি জানাতেই পারেন। এমন আচরণের যুক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর!’’
আনুষ্ঠানিক ভাবে সমর্থনের ডাক শুক্রবারের সমাবেশের জন্য দেওয়া হলেও জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রতিবাদে গোড়া থেকেই সঙ্গে আছে বাম শিবির। লালবাজার অভিযানে গিয়ে রাতভর রাস্তায় অবস্থান করেছিলেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। রাতে তাঁদের জন্য ছাউনি থেকে শুরু করে খাবারের আয়োজনের নেপথ্যে ভূমিকা ছিল সিপিএমের নেতৃত্ব এবং কংগ্রেসের এক পুর-প্রতিনিধিরও। ধর্মতলায় চিকিৎসকদের অনশন-মঞ্চের কাছেও প্রতিদিনের ভিড়ে থাকছেন সিপিএম এবং যুব, মহিলা-সহ তাদের গণ-সংগঠনের লোকজন। এঁদের একাংশও সমাবেশের দিনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ। তবে সিপিএম নেতৃত্ব আপাতত কিল খেয়েও হজম করে নেওয়ার কৌশল নিচ্ছেন। দলে বার্তা দেওয়া হয়েছে, নেপথ্যে থেকে চিকিৎসকদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে যেতে হবে।
চিকিৎসকদের অবস্থানের কাছে বিজেপির দু-এক জন নেতাকে দেখে এর আগে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান দেওয়া হয়েছিল। কামারহাটির সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে হেনস্থার অভিযোগের পরে চিকিৎসকেরা যখন অবস্থান করছিলেন, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার সেখানে ঘুরে বেরিয়ে আসার সময়ে ‘গো ব্যাক’ আওয়াজ উঠেছিল। ধর্মতলায় তেমন কিছু হয়নি। তবে ঘটনাপ্রবাহ এবং জুনিয়র ডাক্তারদের কারও কারও বক্তব্য যে বিভ্রান্তি বাড়াচ্ছে, তা বুঝতে পারছেন সিনিয়র চিকিৎসকদের একাংশ। তাঁদের তরফে মানস গুমটাকে তাই বিবৃতি দিয়ে বলতে হয়েছে, ‘‘হয়তো কিছু বিতর্কিত বিষয় রয়েছে জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের (ডব্লিউবিজেডিএফ) কারও অনভিপ্রেত বক্তব্যে। তাতে হয়তো কিছু মানুষ আহত হয়েছেন, যাঁরা এই আন্দোলনের সাথী এবং সহমর্মী। কিন্তু বৃহত্তর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আপাতত এই ক্ষোভ এবং বিতর্ক সরিয়ে রেখেই আমাদের এগোতে হবে।... গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, এই জনস্পর্ধা এক কথায় অভূতপূর্ব।’’ কোনও বিভাজন তৈরি এবং ‘স্বার্থান্বেষী শক্তি’র ফাঁদে পা দেওয়া থেকে সতর্ক থাকতে সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করেছেন তিনি।
সিপিএমের এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘কিছু বিভ্রান্তি আছে। মাথার উপরে তেমন কোনও চালিকা শক্তি না-থাকলে কিছু সমস্যা হয়, জুনিয়র চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও কানা গলিতে ঢুকে পড়ার একটা আশঙ্কা আছে। তবে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। ঝান্ডা নিয়ে আমরা কখনওই আন্দোলন দখল করতে যাচ্ছি না। আমাদের সমর্থন থাকবে, বাইরে দলীয় স্তরে প্রতিবাদও চলবে।’’ জেলায় জেলায় নাগরিক সংগঠনের পাশাপাশি পুজোর মধ্যে গণ-সংগঠনের উদ্যোগে চিকিৎসকদের আন্দোলনের সমর্থনে অনশন-অবস্থানও করেছে সিপিএম।
সূত্রের খবর, রাজ্য সরকার তেমন কিছু না-করলে জুনিয়র চিকিৎসকেরা অনশন তুলবেন কী ভাবে, সেই প্রশ্ন উঠছে। বামপন্থী চিকিৎসকদের একাংশের বিকল্প প্রস্তাব, আর জি কর হাসপাতালের নির্যাতিতার বাবা-মায়ের মাধ্যমে আবেদন করানো হোক। তবে এই সব প্রশ্নেই নানা মত আছে। এমতাবস্থায় সিপিএমকে আক্রমণের পাশাপাশিই তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা কুণাল ঘোষের মন্তব্য, ‘‘বিনা নোটিসে ধর্মতলায় বসে অনশন শুরু। এ বার চিৎকার— সরকার দেখো, সরকার ‘এগ্জ়িট রুট’ করে দাও, দেখো আমরা অসুস্থ, কিছু হলে সরকার দায়ী!’’ সরকার কী কী করেছে, তার উল্লেখ করে তৃণমূল নেতার সংযোজন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী আগে নিজে ধর্না-মঞ্চে গিয়েছেন, বাড়িতে বৈঠক করেছেন। নবান্নে একাধিক বার বৈঠক। জ্যোতি বসুর মতো পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে তুলে দেননি!’’ অনশন প্রত্যাহারের জন্যই আবেদন জানিয়েছেন কুণাল।
উল্টো দিকে, সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘কোথায় কত জন ডাক্তার গণ-ইস্তফা দিয়েছেন এবং সরকার তা নিয়ে কী করবে, সেটাও বলার যোগ্যতা নেই স্বাস্থ্যসচিবের? জানাচ্ছেন সরকারের উপদেষ্টা! যাঁকে সরকারই ভরসা করে না, তাঁকে আন্দোলনকারীরা ভরসা করবেন কেন? অবিলম্বে স্বাস্থ্যসচিবকে খারিজ করে আলোচনায় বসুক সরকার।’’