Jagadhatri Puja2022

‘আমাদের অনেকেই আছেন, যাঁরা প্রতি বছর জগদ্ধাত্রী পুজোয় অঞ্জলি দেন’, বললেন হাসান শেখ

হাজি নুরের হোটেলে বসেই ঠিক হল পাড়ার সকলে মিলে জগদ্ধাত্রী পুজো করবেন। সাহেব, নারায়ণ, মিনু, চিত্তরঞ্জন, বিমান, মনা, হারুরা তৈরি করে ফেললেন ক্লাব।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২২ ০৮:০০
Share:

‘সম্প্রীতি মা’-র মণ্ডপে হাসানেরা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

সে সময়ে কৃষ্ণনগর শহরে একটিই মুসলিম হোটেল। মালিক হাজি নুর মহম্মদ খান, খুবই দিলদরিয়া মানুষ। তাঁর হোটেলের ভিতরে যত না খরিদ্দারের ভিড়, তার চেয়ে বেশি ভিড় এলাকার ছেলে-ছোকরাদের। সেই ভিড়ে যেমন ছিলেন মনা মুখোপাধ্যায়, তেমনই ছিলেন কেলিম শেখেরা। সকলে একসঙ্গে চা ভাগ করে খান। পাড়ার কারও কোনও সমস্যা হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একজোট হয়ে একসঙ্গে বাঁচেন। তবে তাঁদের একটাই আফসোস। পাড়ায় কোনও জগদ্ধাত্রী পুজো হয় না। পুজোর আনন্দ উপভোগ করতে হলে অন্য পাড়ায় যেতে হয়। ভাবনা মাথায় এল, নিজস্ব একটা জগদ্ধাত্রী পুজো হলে মন্দ হয় না!

Advertisement

যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। হাজি নুরের হোটেলে বসেই ঠিক হল পাড়ার সকলে মিলে জগদ্ধাত্রী পুজো করবেন। সাহেব, নারায়ণ, মিনু, চিত্তরঞ্জন, বিমান, মনা, হারুরা তৈরি করে ফেললেন ক্লাব। সঙ্গে সদস্য হয়ে জুতে গেলেন কেলিম, হালিম, বাদল,ট্যাবা শেখরাও। ক্লাবের নাম হল— ‘নিউ ক্লাব’।

তা-ও প্রায় বছর পঞ্চান্ন আগের কথা। সে ধারা এখনও বহন করে চলেছেন সাহান শেখ, সুজয় চক্রবর্তী, প্রবীণ রায়েরা। এঁদের হাতেই বর্তমানে কৃষ্ণনগরের নিউ ক্লাবের পুজোর দায়িত্ব। শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র কুর্চিপোতা মোড়ের এই পুজোর প্রতিমাকে প্রায় সকলেই ‘সম্প্রীতি মা’ নামে চেনেন। ওই পুজো কমিটির প্রায় দশ বছরের সম্পাদক হাসান শেখ বলেন, “সর্বর্ধম সমন্বয় আমাদের পুজোর মূল মাহাত্ম্য। দেবী এই বিশাল শহরের বিভিন্ন পুজোর আড়ম্বর, জৌলুসের মধ্যে সম্প্রীতির মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন যেন।’’

Advertisement

পঞ্চান্ন বছর আগে যাঁদের হাত ধরে ‘সম্প্রীতি মা’-এর পুজো শুরু, তাঁদের অন্যতম কেলেমি শেখের ছেলে হাসান শেখ। তিনি বলেন, “আমাদের অনেকেই আছেন, যাঁরা প্রতি বছর জগদ্ধাত্রী পুজোয় অঞ্জলি দেন। এঁদের মধ্যে আমিও এক জন।”

ধর্মে মুসলিম হয়েও ভিন্ন ধর্মের পুজোর আচারে অভ্যস্ত হলেন কী ভাবে? হাসান শেখ, ছোট শেখরা বলছেন, “আসলে অঞ্জলি দিতে ভাল লাগে। এটাও তো পুজোর একটা অংশ। আমরা পুজোর সবটা জুড়ে থাকতে চাই।”

পাশ থেকে ক্লাবের বর্ষীয়ান সভাপতি প্রবীর রায় বলে ওঠেন, “এক দিন মুসলিম হোটেলে বসে যে জগদ্ধাত্রী পুজোর পরিকল্পনা হয়েছিল, আজ সেই পুজো ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে সব মানুষের কাছে উৎসব হিসাবে পৌঁছে গিয়েছে। আমরা চাই, আমাদের পুজো সব ধর্মের মানুষের মিলনভূমিতে পরিণত হোক।”

এ যে কেবল মুখের কথা নয়, আচরণে তিনি ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে মানুষের সম্মিলিত উৎসবে বিশ্বাস রাখেন, সে সম্প্রীতির নজিরও রয়েছে। প্রবীর নিজেও আবার ইদ কমিটির দীর্ঘ দিনের সভাপতি। সেখানেও প্রতি বার তাঁর সক্রিয় যোগদান থাকে।

জানা গেল, ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলিম সম্প্রদায়ের। জগদ্ধাত্রী পুজোর কর্ম-কর্তারাও বেশির ভাগ মুসলিম। এবারের পুজোর বাজেট প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। যার একটা বড় অংশের খরচ বহন করছেন এঁরাই। ক্লাবের পুরুষ সদস্যদের পাশাপাশি কোনও কোনও মুসলিম মহিলাও জগদ্ধাত্রী পুজোর অঞ্জলি দেন। ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে এই পুজো যেন সকলের উৎসব।

পুজো কমিটির অন্যতম সদস্য সুজয় চক্রবর্তী বলেন, “আমরা এখানে কাউকে হিন্দু বা মুসলিম বলে দেখি না। একটা সময়ে পুজো নানা কারণে ছোট হয়ে গিয়েছিল। হাসানেরা এগিয়ে এসে দায়িত্ব না নিলে পুজো চালু রাখাই হয়তো কঠিন হয়ে পড়ত।”

পুজোয় আচার পালনে ধর্মের প্রতিনিধি কী মনে করেন এই বিষয়ে? ওই পুজোর পুরোহিত অরিজিৎ চক্রবর্তী বলছেন, “এই ক্লাবে পুজো করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে হয়। আমরা মুখে যে শান্তি ও সম-প্রীতির কথা বলি, ওঁরা কাজে সেটা করে দেখান।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement