অন্ডালের এক পরিত্যক্ত খাদান। এই ধরনের খাদানেই মাছ চাষের প্রকল্প হাতে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। — নিজস্ব চিত্র।
আবাদ করলে হয়তো সোনা ফলানো যেত। কিন্তু আবাদির অভাবে মানবজমিন পতিত থেকে যাওয়ায় আক্ষেপ করেছেন শ্যামাসঙ্গীতের কবি। কয়লা তোলার পরে খনির পরিত্যক্ত খাদানগুলোকে আর অনাবাদি ফেলে রাখতে চাইছেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি চাইছেন খাদানের গভীর জল আবাদ করতে। মানে সেই জলে মাছ চাষ করে তার পতিত-দশা মোচন করতে।
মুখ্যমন্ত্রীর আশা, এই প্রকল্পে দু’টি লক্ষ্য পূরণ হবে। দু’টি লক্ষ্য কী এবং কী ভাবে সেগুলো পূরণ হবে, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ। তিনি জানান: l অনটন খনি এলাকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। কয়লা খাদানের জলে মাছ চাষ করা গেলে তাঁদের রুটিরুজির সংস্থান হবে। l আর রসনা তৃপ্তির ব্যবস্থা হবে খাদ্যরসিকদের। রাজ্যে মাছ উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হলেও তাতে চাহিদা মেটে না। খাদানে মাছ চাষ হলে সেই ঘাটতির কিছুটা পূরণ করা যাবে।
মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিনব উদ্যোগে সামিল হচ্ছে কোল ইন্ডিয়াও। খাদানগুলির মালিক তারাই। তাই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই ইস্টার্ন কোলফিল্ডস এই প্রকল্পে হাত মিলিয়েছে বলে জানান মৎস্যমন্ত্রী। আসানসোল-রানিগঞ্জ কয়লা খনি অঞ্চলের সালানপুর ব্লকের ১২টি পরিত্যক্ত খাদানে শুরু হবে এই প্রকল্প। স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে মৎস্য দফতর থেকে তাদের লাইসেন্স এবং মাছের চারা দেওয়া হবে। দেওয়া হবে প্রশিক্ষণও। মাছ চাষের সঙ্গে সঙ্গে তা বিক্রিও করবে স্বনির্ভর গোষ্ঠী। চলতি বছরেই পরীক্ষামূলক ভাবে মাছের চারা ছাড়া হবে ওই সব খাদানে।
মাছ চাষের জন্য খাদান ব্যবহারের কারণ ব্যাখ্যা করে এক প্রশাসনিক কর্তা জানান, ১০০ দিনের কাজে রাজ্যে অসংখ্য পুকুর কাটা হয়েছে। ওই সব পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে। সরকারের ঝিল ও পুকুরে মাছ চাষ বাড়াতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ‘সবার জন্য মাছ আর সব জলাশয়ে চাষ’, ‘স্বাস্থ্য ও সম্পদ বৃদ্ধির জন্য মাছ চাষ করো’ ইত্যাদি স্লোগান তৈরি করে প্রচারও শুরু হয়েছে। কিন্তু মাছের চাহিদা মিটছে না। তাই মাছের উৎস বাড়াতে খাদান বেছে নেওয়া হয়েছে। মৎস্য দফতর জানাচ্ছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় মাছের চাহিদাও বেড়েছে। ২০১৫-’১৬ আর্থিক বছরে রাজ্যে প্রায় ১৬ লক্ষ ৭১ হাজার টন মাছ উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু চাহিদা প্রায় ১৮ লক্ষ টন। ঘাটতি মেটাতে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু থেকে বিশেষ করে বড় রুই ও কাতলা আমদানি করতে হচ্ছে। ‘‘এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী অনেক দিন ধরেই পরিত্যক্ত খাদানগুলিকে কাজে লাগানোর কথা বলছিলেন কেন্দ্রকে। এখন আমরাই মাছ চাষের জন্য খাদানকে ব্যবহার করতে চাইছি,’’ বললেন চন্দ্রনাথবাবু।
মৎস্য দফতরের বক্তব্য, জমি (এ ক্ষেত্রে জলাজমিন) তো তৈরিই আছে। পরিত্যক্ত খাদানগুলিতে বছরের অধিকাংশ সময় গভীর জল থাকে। রুই, কাতলা, মৃগেল-সহ নানা ধরনের মাছ চাষ করা যাবে সহজেই। জলাশয়ের একটি অংশ ঘিরে বড় আকারের রুই-কাতলা উৎপাদন করা হবে। বড় বড় খাঁচায় পাঙাস, তেলাপিয়া, কালবোস চাষের পরিকাঠামোও গড়ে তোলা হবে। পুঁটি, মৌরলা, ট্যাংরা, মাগুরের মতো মাছ চাষেরও পরিকল্পনা রয়েছে। এক মৎস্যকর্তার দাবি, প্রথম পর্বে ১২টি খাদানে পুরোদমে মাছ চাষ শুরু হলে প্রতি হেক্টরে ২০০০-৩০০০ কিলোগ্রাম মাছ উৎপাদন হবে।
‘‘মাছ চাষ শুরু হয়ে গেলে সালানপুরের স্থানীয় বাজারের চাহিদা অনেকটা মিটবে। পুরোদমে উৎপাদন শুরু হলে রাজ্যের চাহিদাও মিটবে খানিকটা,’’ বলছেন চন্দ্রনাথবাবু।
শুধু সালানপুর নয়, রাজ্যে কোল ইন্ডিয়ার প্রায় ৭৮টি পরিত্যক্ত কয়লা খাদান রয়েছে। তার আয়তন প্রায় ২৫০ হেক্টর। মন্ত্রী জানান, ওই সব খাদান নিয়ে কেন্দ্রের কাছে বিশেষ প্রকল্প গড়ার দাবি জানাচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। অনেকটা সেই কারণেই প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে কোল ইন্ডিয়া। প্রকল্প-খরচের একটা বড় অংশ দেবে ইস্টার্ন কোলফিল্ডস। তাদের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে মৎস্য দফতরের। ইস্টার্ন কোলফিল্ডসের এক কর্তা জানান, স্থানীয় মানুষের জমি নিয়ে খনি কেটে কয়লা তোলা হয়েছিল। এখন সেই সব খনি-খাদান পরিত্যক্ত। যে-হেতু খনি অঞ্চলে অন্য ধরনের জীবিকার সুযোগ বিশেষ নেই, তা-ই খাদানের জলে মাছ চাষের প্রস্তাবে তাঁরা আগ্রহী। ইস্টার্ন কোলফিল্ডসের অন্যতম ডিরেক্টর শিবনারায়ণ পাত্র বলেন, ‘‘সরকারের কাছে সবিস্তার প্রকল্প রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। আমাদের দিক থেকে কতটা সাহায্য করা যায়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
এই প্রকল্পে যুক্ত থাকবে স্থানীয় পঞ্চায়েত এবং জেলা প্রশাসনও। ঠিক হয়েছে, ধাপে ধাপে সব ক’টি পরিত্যক্ত খাদানেই মাছ চাষ করা হবে। আর তাকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হবে গুদামঘর, ছোট পাইকারি বাজার, বিশ্রামাগার ইত্যাদি।
প্রশ্ন উঠছে, খাদানের নানান খনিজ পদার্থ ও রাসায়নিক মিশ্রিত জলে জন্মানো মাছ স্বাস্থ্যের উপযোগী হবে তো? এক মৎস্যকর্তা জানান, পরিবেশগত সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। খনির জলে বেড়ে ওঠায় মাছের শরীরে ক্ষতিকারক পদার্থ ঢোকার আশঙ্কা আছে কি না, এই জলে মাছ কত দিন বাঁচছে, কতটা সময়ে কত বড় হতে পারে, মাছের খাবার কী হবে— সব নিয়ে সমীক্ষা চলছে। তা শেষ হলেই মাছ চাষ শুরু হবে পুরোদমে।