(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম আদানি (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।
তাজপুরে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য নতুন করে দরপত্র তথা টেন্ডার জমা দেওয়ার কথা বললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকে মমতা বলেন, ‘‘তাজপুরে সমুদ্রবন্দর হবে। আপনারা তাতে অংশগ্রহণ করতে পারেন।’’ মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল তৈরি হয়েছে, গত বছর সেপ্টেম্বরে আদানি গোষ্ঠীর এই টেন্ডার পাওয়ার যে কথা ঘোষণা করা হয়েছিল সরকারের তরফে, তা কি তা তাহলে বাতিল হয়ে গেল? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত আদানিকে কি তা হলে দূরত্বের বার্তা দিলেন মমতা?
গত বছর রাজ্য সরকারের তরফে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ঘোষণা করেছিলেন, তাজপুর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বরাত পেয়েছে আদানি গোষ্ঠী। তা নির্মাণে খরচ হবে ২৫ হাজার কোটি টাকা। বিধানসভায় মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে সাংবাদিক বৈঠকে এই ঘোষণা করেছিলেন ফিরহাদ। সূত্রের খবর, এর মধ্যেই কেন্দ্রের তরফে একটি চিঠি আসে রাজ্যের কাছে। তাতে বলা হয়, বন্দর নির্মাণে ‘বিতর্কিত’ যেন কিছু না করা হয়। তার পরেই মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, আদানিদের কাউকে দেখা যায়নি বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চে। যা সামগ্রিক ভাবে নবান্ন-আদানি ‘দূরত্ব’ রচনার ভূমিকা হিসাবেই দেখছেন অনেকে।
প্রসঙ্গত, আদানির সঙ্গে মোদীর সখ্য নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগ কম নেই। সংসদে এ নিয়ে সরব হয়েছিলেন রাহুল গান্ধী থেকে তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র। মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ‘ঘুষের’ বিনিময়ে আদানিদের বিরুদ্ধে সংসদে প্রশ্ন তুলেছিলেন কৃষ্ণনগরের সাংসদ। তার পর সেই অভিযোগ নিয়ে এথিক্স কমিটি তদন্ত করে এবং মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজের সুপারিশ পাঠানো হয়েছে লোকসভার স্পিকারের কাছে। মঙ্গলবার আদানিদের সঙ্গে মমতার ‘দূরত্বের’ বার্তার পর রাজনৈতিক মহলের অনেকে বলছেন, পরোক্ষে মহুয়ার পাশেই দাঁড়ালেন মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী। অনেকে আবার কয়েক কদম এগিয়ে বিষয়টিকে ‘মহুয়ার জয়’ বলেও ব্যাখ্যা করছেন। কারণ,আদানির বিরুদ্ধে মহুয়া যেমন একবগ্গা ভাবে লড়ে যাচ্ছিলেন, তার সঙ্গে তৃণমূল পরিচালিত সরকারের তরফে তাজপুর বন্দরের ভার আদানির উপর দেওয়ার ‘বৈপরীত্য’ নিয়ে শাসক শিবিরকেও একটা ‘অস্বস্তি’র মধ্যে পড়তে হচ্ছিল। মমতার আদানি সংক্রান্ত ঘোষণায় তারও নিরসন ঘটল। পাশাপাশিই, মহুয়ার পক্ষেও বিষয়টি ‘স্বস্তিজনক’ হল। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি দলীয় পদের রদবদলে মহুয়াকে কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি মনোনীত করেছেন মমতা। ফলে সংগঠনেও তাঁর ‘গুরুত্ব’ বেড়েছে।
একই সঙ্গে সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী শিবিরেও মমতা রাজনৈতিক বার্তা দিতে পেরেছেন বলে কারও কারও অভিমত। উল্লেখ্য, মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, শিল্পপতি দর্শন হীরানন্দানির থেকে ‘উপহার এবং ঘুষ’ নিয়ে সংসদে আদানিদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করেছিলেন মহুয়া। মঙ্গলবার বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চে দেখা যায়নি হীরানন্দানিদের কোনও প্রতিনিধিকে।
গত সেপ্টেম্বরে তাজপুরের বরাত পাওয়ার ক্ষেত্রে যখন আদানিদের নাম চূড়ান্ত হয়েছিল, সেই সময়ে জানা গিয়েছিল জিন্দল গোষ্ঠীও টেন্ডার জমা দিয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত হয় আদানিদের নাম। তার পর বঙ্গোপসাগর দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। আমেরিকার সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টে বিতর্কের মুখে পড়ে গৌতম আদানি গোষ্ঠী। সেখানে উল্লেখ করা হয়, জালিয়াতি করে শেয়ারের দাম ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছিল আদানি গোষ্ঠী। তা নিয়ে তোলপাড় হয় জাতীয় রাজনীতি। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে তাজপুরে বন্দর নির্মাণে আদানিদের ‘বাদ’ পড়া তাই সব দিক থেকেই ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করা হচ্ছে।