Sovan Chatterjee

‘... তুই শিগগিরি বাড়ি ছাড়, শোভনকে বলেছিলেন দিদি’: বিস্ফোরক বৈশাখী

কাঙ্খিত নয় বলেই কোনও বিস্ফোরক বিষয় নিয়ে তিনি এখনও মুখ খোলেননি, কাঙ্খিত নয় বলেই কারও কোনও গোপন সম্পর্কের বিষয়ে তিনি প্রকাশ্যে কোনও কথা এখনও বলেননি— ইঙ্গিত বৈশাখীর।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১০:০০
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

তাঁকে নিয়ে বিস্তর চর্চা গোটা রাজ্যে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীদের অন্যতম ছিলেন যিনি, সেই শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘দিদি’র সাম্প্রতিক দূরত্বের কারণ তিনি। মিল্লি আল-আমিন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে এমন কথাই বলছেন অনেকে। আনন্দবাজার ডিজিটালকে দেওয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে বৈশাখীর দাবি, কোথাও কোনও দূরত্ব তৈরি হয়নি। শাসক দলের শিক্ষা সেল থেকে বাদ পড়ার পরেও বৈশাখীর মত, মমতা-শোভনের সম্পর্ক মা-ছেলের মতো। কিন্তু শোভনের দাম্পত্যটা কেন ভাঙার মুখে? বৈশাখীর ইঙ্গিত, কোনও একটা লুকনো সম্পর্কের কথা জেনে ফেলেছেন শোভন, তাতেই ভাঙছে বিয়ে।

Advertisement

কী ধরনের লুকনো সম্পর্ক? কার সঙ্গে কার সম্পর্ক? কে লুকিয়েছিলেন সম্পর্কের কথা? এ প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হলেন না রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষিকা। বললেন, ‘‘শোভনদা নিজে যত ক্ষণ না বলছেন, তত ক্ষণ সে কথা বলা আমার অন্তত উচিত হবে না।’’ তবে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, কী কারণে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ২২ বছরের সংসারে অশান্তির আগুন জ্বলল, তা শোভন জানেন, রত্না জানেন আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন।

কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ দিনের পার্শ্বচর শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কলেজ শিক্ষিকা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্কটা ঠিক কী রকম? এই প্রশ্ন নিয়ে তোলপাড় হয়ে গিয়েছে রাজ্যের রাজনীতি। প্রকাশ্যে মন্তব্য করা থেকে অধিকাংশই বিরত থেকেছেন। কিন্তু নিজেদের ঘনিষ্ঠ পরিসরের চর্চায় বা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় রাজনীতিকদের অনেকেই নানা রকম কাটাছেঁড়া চালিয়েছেন শোভন-বৈশাখীর সম্পর্ক নিয়ে। নানা রকম জল্পনা ছড়িয়েছে।

Advertisement

স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কলকাতার মেয়রের বিচ্ছেদ হচ্ছে বৈশাখীর কারণেই— সাধারণ জনপরিসরেও এমন আলোচনাও শোনা গিয়েছে। কিন্তু এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে বৈশাখীর মন্তব্য, ‘‘হয়তো আমাকে বিশেষ বান্ধবী বলে তৈরি করার পিছনে কোনও বিশেষ বন্ধুকে লুকিয়ে রাখার একটা প্রচেষ্টা আছে, এ কথা শোভনদা-ই বলেছিলেন একটা টিভি চ্যানেলে।’’ বৈশাখী কারও নাম করলেন না ঠিকই, তবে ইঙ্গিত স্পষ্ট তাঁর— ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্তরে কোনও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন শোভন চট্টোপাধ্যায়, সেই কারণেই আর রত্নার সঙ্গে থাকতে চান না তিনি।

দেখুন সেই এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারের ভিডিয়ো:

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে শাসক দলের যে সংগঠন, সেই ওয়েবকুপা-র সাধারণ সম্পাদক পদে মাস ছয়েক আগে পর্যন্তও আসীন ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষিকা। সংগঠনের সভানেত্রী পদে থাকা কৃষ্ণকলি বসুর সঙ্গে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বন্দ্ব বেশ প্রকট ভাবেই ছাপ ফেলছিল সংগঠনে। সেই দ্বন্দ্ব ঠেকাতেই তৃণমূল নেতৃত্ব মাস ছয়েক আগে ওয়েবকুপার রাজ্য কমিটি ভেঙে দেন বলে শোনা গিয়েছিল তৃণমূল সূত্রে। সম্প্রতি তৃণমূল ভবনে সাধারণ সভা ডেকে ওয়েবকুপা রাজ্য কমিটির পুনর্গঠন হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক পদে ফিরে আসা বা রাজ্য কমিটিতে ঠাঁই পাওয়া দূরের কথা, সাধারণ সভায় ডাকও পাননি শোভন-ঘনিষ্ঠ অধ্যাপিকা। তৃণমূলের অন্দরে তো বটেই, বাইরেও গুঞ্জন—শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার মাশুল চোকাতে হল বৈশাখীকে।

আরও পড়ুন: শোভনের সঙ্গে সম্পর্কের জের, বৈশাখীকে ছেঁটে দিল তৃণমূল

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, শোভন চট্টোপাধ্যায় কি এখন নেতৃত্বের চক্ষুশূল? যদি না হন, তা হলে শোভন-ঘনিষ্ঠ হওয়ার ‘অপরাধে’ কাউকে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে একেবারে সংগঠনের বাইরে নিক্ষেপ করা হবে কেন? এ প্রশ্নে খুশিই হলেন কলেজ শিক্ষিকা। বললেন, ‘‘শোভন চট্টোপাধ্যায় তো চক্ষুশূল নন, চক্ষুশূল আসলে আমি।’’ উদাহরণ তুলে ধরে বৈশাখীর ব্যাখ্যা, ‘‘মুকুল রায় চক্ষুশূল হয়ে গেলেন, তাই তাঁর পতন ঘটল। তার পরে মুকুল রায়ের অনুগামীদের পতন ঘটল। শোভন চট্টোপাধ্যায় যদি চক্ষুশূল হতেন, তা হলে আগে তো শোভনের পতন ঘটত। তার পরে তো শোভন অনুগামী বৈশাখীর পতনের প্রশ্ন আসত।’’ তা হলে ওয়েবকুপা থেকে এ ভাবে সরিয়ে দেওয়া হল কেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে? কলেজ শিক্ষিকার জবাব, ‘‘আমাকে যাঁরা চান না, তাঁরাই এটা করালেন।’’

বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় যা-ই বলুন, মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে যে তাঁর উপরে বিরক্ত, সে কথা আর গোপন নেই। শোভন-বৈশাখীর সম্পর্ক নিয়ে কখনও বিধানসভায় প্রকাশ্যে শোভনের প্রতি তির্যক মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কখনও ক্যাবিনেট বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে শোভনকে তিনি সতর্কবার্তা দিয়েছেন বলে তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে। ওয়েবকুপা থেকে তাঁর সম্পূর্ণ অপসারণের অন্যতম কারণ কি দলনেত্রীর এই বিরক্তি নয়? দলনেত্রীর বিরক্তি যে তাঁর বিপক্ষে গিয়েছে, তা বৈশাখী মানছেন। তবে তাঁর দাবি, অনেক কথা ভুল ভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে, অনেক বিকৃত তথ্য তাঁর কাছে পরিবেশন করা হয়েছে।

কারা বিকৃত তথ্য পরিবেশন করলেন? কারা তাঁর উত্থান মানতে পারলেন না? তাঁকে সরাতে পেরে কারা খুশি হলেন? বৈশাখীর অকপট এবং বিস্ফোরক জবাব, ‘‘কিছু মানুষ হয়তো আমার কাছে কখনও কখনও প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন কিছু ব্যাপারে। তাঁরা এমন একটা ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন যে, আমি হলাম সেই মনমোহিনী মানুষ, যিনি এসে ওঁর (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের) সুখের সংসার ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।’’

অর্থাৎ বৈশাখীর বক্তব্যের সারকথা কী? সারকথা হল— যাঁরা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, তাঁরা অসন্তুষ্ট, যাঁরা শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বকে সাদা চোখে দেখতে পারেননি, তাঁরা অসন্তুষ্ট, আর তাঁরাই অসন্তুষ্ট করে তুলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। প্রশ্ন হল, শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বকে অনেকেই মেনে নিতে পারলেন না কেন? কেন অনেকেই অন্য চোখে দেখলেন এই সম্পর্ককে? এই সম্পর্কটার মধ্যে কি কোনও অস্বচ্ছতা বা ধোঁয়াশা রয়েছে? বৈশাখী বলেন, ‘‘আমার জীবনে কোনও ধোঁয়াশা বা ধূসর অঞ্চল নেই। আমি হয় সাদা, না হয় কালো।’’ শোভন-বৈশাখীর সম্পর্ক সাদা, না কালো? বৈশাখীর সপ্রতিভ জবাব, ‘‘একেবারেই সাদা। আমি কিছু পাওয়ার জন্য ওঁরা কাছে আসিনি, কোনও মুখোশ পরে আসিনি, আমার রাজনৈতিক যাত্রাপথের জন্যও ওঁকে আমার প্রয়োজন ছিল না। আর যে যে কারণে আমার প্রতি কেউ আসক্ত হতে পারেন, সেই সব দিক থেকে ওঁর কোনও উৎসাহই আমাকে নিয়ে ছিল না।’’

কথা বলতে বলতে কিছুটা আবেগপ্রবণও সম্ভবত হয়ে পড়লেন বৈশাখী। তবে তার প্রকাশটাও ঘটালেন স্বভাবসিদ্ধ পরিমিতি বোধের মধ্যে দিয়েই। কথা হচ্ছিল কাদা ছোড়াছুড়ি নিয়ে, কথা হচ্ছিল বিচলিত হয়ে পড়া নিয়ে। বৈশাখী বললেন, ‘‘কেউ হয়তো আমার সন্তানের কথা খেয়াল করল না। তাই আমার গায়ে অনেকটা কাদা লেপে দিতে পেরেছে। কিন্তু আমি এখনও মনে করি যে শোভন চট্টোপাধ্যায়েরও দু’জন সন্তান আছে। নিজের মা সম্পর্কে কোনও খারাপ কথা শোনা তাদের জন্যও কাঙ্খিত নয়।’’ কাঙ্খিত নয় বলেই কোনও বিস্ফোরক বিষয় নিয়ে তিনি এখনও মুখ খোলেননি, কাঙ্খিত নয় বলেই কারও কোনও গোপন সম্পর্কের বিষয়ে তিনি প্রকাশ্যে কোনও কথা এখনও বলেননি— ইঙ্গিত বৈশাখীর।

"শোভন চট্টোপাধ্যায় আমাকে মিথ্যা বলবেন না বলেই আমি বিশ্বাস করি"

প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলুন বা না খুলুন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব জানেন, শোভন চট্টোপাধ্যায়ই তাঁকে সব জানিয়েছেন। বৈশাখীর দাবি এমনই। তিনি বললেন, ‘‘এই (বিয়ে ভাঙার) সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাকে শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, আমি পরিষ্কার দিদিকে বলেছি যে, এই কারণে বেরিয়ে যেতে আমি বাধ্য হয়েছি এবং আমাকে দিদি বলেছেন, তুই শিগগিরি বাড়ি ছাড়।’’ অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানিয়েই শোভন চট্টোপাধ্যায় বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র সরে গিয়েছেন? বৈশাখী বললেন, ‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, একেবারেই। কথা বলে উনি বাড়ি ছেড়েছিলেন। আমাকে শোভন চট্টোপাধ্যায় তেমনই বলেছিলেন এবং শোভন চট্টোপাধ্যায় আমাকে মিথ্যা বলবেন না বলেই আমি বিশ্বাস করি।’’

আরও পড়ুন: ফের যেন অগ্নিপরীক্ষা, পুড়ে ছাই বাগড়ি বাজার, পুজোর আগে সর্বস্বান্ত বহু​

বৈশাখীর ব্যাখ্যা যা-ই হোক, যাবতীয় বিতর্কের কেন্দ্রে কিন্তু শোভন-বৈশাখী সমীকরণ নিয়ে তৈরি হওয়া জল্পনাটাই। শাসক দলের বৃত্তে বৈশাখীর আগমন, উত্থান, শোভনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি, তা নিয়ে নানা কানাঘুঁষো শুরু হওয়া, রত্না-শোভনের বিবাদ প্রকাশ্যে আসা, বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা শুরু হওয়া, দলনেত্রীর কাছে শোভনের তিরস্কৃত হওয়া, শোভনের গুরুত্বে কোপ পড়া এবং সব শেষে ওয়েবকুপা থেকে বৈশাখীর অপসারিত হওয়া— গোটা একটা বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হল। আর বৃত্তটা সম্পূর্ণ হওয়ার পরে এই প্রথম এত খোলামেলা ভাবে এবং এত বিশদে মুখ খুললেন বৈশাখী। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠল, এত টানাপড়েনের প্রয়োজন কী? এত বিতর্ক সহ্য করেও কেন বয়ে নিয়ে যাওয়া এই সম্পর্ককে? আরও দৃঢ় উত্তর এল এ বার।

আরও পড়ুন: আগুন লেগে গেল ছাড়পত্র দেওয়ার দু’মাসের মধ্যেই

বৈশাখী বললেন, ‘‘শোভন চট্টোপাধ্যায়ের উপরে আমার বহু কারণে খুব রাগ হয়। অন্য ক্ষেত্রে এ রকম হলে হয়তো ঝট করে সম্পর্ক শেষ করে দিতে পারতাম। এ ক্ষেত্রে তা করার আগে আমি ভাবি যে, এই সম্পর্কটা শেষ করলে দশটা লোক খুব খুশি হয়ে যাবে। ওই জেদে সম্পর্কটা আবার জোড়া লেগে যায়।’’ তাঁর আর শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধুত্ব নিয়ে এত মাথাব্যথা যদি অন্যদের না থাকত, তা হলে হয়তো এই বন্ধুত্ব এত দিন না-ও টিকতে পারত— সহাস্যে বলেন বৈশাখী।

(ভিডিয়ো: মৃণালকান্তি হালদার)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement