ডোরিনা ক্রসিংয়ের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: পিটিআই।
আরজি করে পুলিশের উপর হামলার নিন্দা করেছেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘সারা রাত ঘুমাইনি। জেগে ছিলাম, কখন শান্তি ফিরে আসবে।’’ মুখ্যমন্ত্রী গান্ধীজির পথে থেকে অহিংস আন্দোলনেরও ডাক দিয়েছেন।
মমতা তদন্ত প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমি চাই না কুৎসা করতে। সিবিআই তদন্ত করছে। বিচারাধীন। আইন হাতে নেবেন না।’’ শেষে মমতা স্লোগান দিয়ে বলেন, ‘‘দোষীদের ফাঁসি চাই। রাম-বামের চক্রান্ত ব্যর্থ করুন। কুৎসাকারীদের ব্যর্থ করুন। বাংলা মাকে অসম্মানের জবাব দাও বিজেপি।’’ মমতা বলেন, ‘‘এটা তাঁর দলের সিদ্ধান্ত যে, দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক। আমি নির্দেশ দিইনি বলে দলের কেউ মুখে খোলেননি। কুৎসা করে গিয়েছে। আজ দেখলেন, কী হল?’’ তিনি এ-ও দাবি তোলেন, রবিবারের মধ্যে দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক।
মমতা বলেন, ‘‘আমি যত শান্ত থাকি, আপনাদের মঙ্গল। আমাকে আঘাত করলে আমি হয়ে যাই টর্নেডো, সাইক্লোন। নিজেকে কেয়ার করি না। মানুষকে কেয়ার করি। যাঁরা দোষী, তাঁদের কথা না বলে আমাকে মারতে যান। কিছু রয়েছে যদু বংশ। তাঁদের কেউ কেউ আমাদের ভাল জিনিস ভাল বলে। তাদের কাজ বদনাম করে দাও। আমাদের সিইউয়ের ছেলেমেয়েরা পিএইচডি করা। যাদবপুরেও তাই। ’’
মমতা বলেন, ‘‘আমরাই একমাত্র লোকসভায় ৩৮ শতাংশ মহিলাদের নির্বাচিত করে পাঠিয়েছি। পুরসভায় ৫০ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। সন্তান মানুষের জন্য ছুটি দিয়েছি। স্বাস্থ্যসাথী কার্ড হোল্ডার হলেন পরিবারের মহিলা। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী রয়েছে। ছেলেদের জন্যও রয়েছে।’’ তিনি আরও জানান, চাকরি দিতে চান। কিন্তু হাই কোর্টে একটার পর একটা পিটিশনের কারণে বাধা পাচ্ছে।
মমতা বলেন, ‘‘অপপ্রচার করেছেন আপনারা। বিজেপি নেতা কলকাতা পুলিশের কমিশনারকে বলছেন কুকথা বলেছেন। বিজেপির হাতের তামাক খাচ্ছে কংগ্রেস, সিপিএম। ’’
মমতা বলেন, ‘‘এ সব করে আজ আপনারা এক পায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আর একটা পা নীতীশের উপর, চন্দ্রবাবুর উপরে। দেশে একটাও মহিলা মুখ্যমন্ত্রী করেননি। আমি নিজেকে মহিলা মনে করি না। আমার কাছে ভাই, বোন, হিন্দু, শিখ, সকলে সমান। আমরা চরিত্র হনন করে, কুৎসা করে খাই না।’’
মমতা বলেন, ‘‘মণিপুর সামলাতে পেরেছেন? নাগাল্যান্ড, অসম সামলাতে পেরেছেন? মিথ্যে প্রমাণিত হয়। যতই কুৎসা করা হোক। ওগুলো ফেক ভিডিয়ো। সত্য নয়। সত্য মানতে আমার অসুবিধা নেই।’’
মমতার মুখে ফিরে এল সাঁইবাড়ির ঘটনা। কেশপুর, নানুরের কথা স্মরণ করালেন তিনি। তখন তিনি রেলমন্ত্রী।
মমতা স্মরণ করালেন নন্দীগ্রামের কথায়। জানালেন, নন্দীগ্রামে গণহত্যার পর তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। উত্তরাখণ্ডে নার্সের ধর্ষণ, মৃত্যুর ন’দিন পর দেহ মিলেছে। তাঁর মতে, যাতে বিক্ষোভ শুরু না হয়, সে কারণে এ সব করা হয়েছে। কিন্তু বাংলায় এ সব হয় না।
মমতা বলেন, ‘‘হাসপাতালে এত জন থাকেন রাতে, এই ঘটনা ঘটল কী ভাবে?’’ তিনি আরও প্রশ্ন তুললেন, চিকিৎসক সকাল ৯টা পর্যন্ত নিখোঁজ থাকার পরেও কেন কেউ খবর নিলেন না।
মমতা বলেন, ‘‘রাজনীতির নাম করে বাংলায় আগুন লাগালেন। স্ক্যান ভেঙে দিয়ে এলেন। একটা হাসপাতাল তৈরি করতে গেলে কত জিনিস নিতে হয়। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কত টাকার জিনিস নষ্ট হয়েছে। বলল, বলতে পারছি না। ৫০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে। ১০০ কোটি টাকাও হতে পারে। দেবেন টাকাটা বিজেপি এবং সিপিএম? যাঁরা বড় কথা বলছেন, টাকা তুলে গুন্ডাদের টাকা দিচ্ছেন? হাসপাতাল গুন্ডামির জায়গা নয়। সেবা দেওয়ার জায়গা।’’ মমতা চিকিৎসক এবং নার্সদের কাজে যোগ দেওয়ার অনুরোধ করেন।
মমতা আরও বলেন, ‘‘চিকিৎসকেরা খুব ভাল কাজ করেন। হাসপাতালে এত জন থাকেন রাতে, এই ঘটনা ঘটল কী ভাবে? ডিউটিতে যাঁরা থাকেন, প্রতি ঘণ্টায় রোগী কেমন রয়েছেন, দেখতে হয়। ডাক্তারদেরও অনেক কষ্ট করে কাজ করতে হয়। পুলিশের মতো।’’ বিজেপির উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘এটা নিয়ে রাজনীতি করতে নামলেন বলে আমাদের নামতে হল। আন্দোলনের মধ্যেই আমার জন্ম, মৃত্যু হবে।’’
মমতা বলেন, ‘‘আমাদের মহিলা কমিশন আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। একটা মহিলা কমিশন কাজ করলে অন্য মহিলা কমিশন কাজ করতে পারে না। আমি বলেছিলাম বাবা-মাকে, আমরা দোষীদের শাস্তি দেব। রবিবার পর্যন্ত সময় দিন। নয়তো সিবিআইকে দিয়ে দেব। সিপিএম, বিজেপি, আপনারা অপেক্ষা করতে পারতেন! পরিবারকে দোষ দিই না। আপনারা সময় দিলেন না। ১৬৪ জনের দল তৈরি করা হয়েছিল গত এক মাসের সিসিটিভি ফুটেজ দেখার জন্য। অনেককে ডাকা হয়েছিল। সময় দিলেন না। হাসপাতালের এভিডেন্স নিতে সময় লেগেছে। এই প্রক্রিয়া বাইরে বলা যায় না। দোষী নিজের মতো ব্যবস্থা নিতে পারে। সাবধান হতে পারে। পুলিশ আমায় সব দেখিয়েছে। আপনারা রাজনীতি করলেন। আমি এটা নিয়ে রাজনীতি করতে চাই না। আপনাদের তর সইল না।’’
মমতা বলেন, ‘‘আমরা কামদুনিতে দু’জনকে ফাঁসি দিয়েছি। ধনঞ্জয়কে ফাঁসি দিয়েছিলেন। বুদ্ধবাবুর স্ত্রী মীরাদেবী মঞ্চে দাবি করেছিলেন। কিন্তু আসল লোককে কি ফাঁসি দিয়েছেন? রোজ কাগজে পড়ছি। যিনি ফাঁসি দিয়েছেন, তিনি বলছেন, আমি মনে মনে কষ্ট পাচ্ছি। ধনঞ্জয় বাবুর স্ত্রী বলছেন, শান্তি পাচ্ছি।’’
মমতা বলেন, ‘‘আমরা ভোটে জিতে এসেছি। নিজে নিজে জিতিনি। নির্বাচন কমিশন সেই ভোট পরিচালনা করেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রকল্পের টাকা আটকে রেখেছেন। বিজেপি ভাবছে, বাংলাদেশে এত ছাত্র মারা গিয়েছে, আমি বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলতে পারি না! বলিও না। দেশের বিষয়। কিন্তু আমরা ভদ্রতা করি বলে ভাববেন আমরা দুর্বল হয়ে গিয়েছি, তা নয়। আপনারা সামলান দেশ। বাংলায় ঘটনা হলে সরকার ব্যবস্থা নেয়।’’
মমতা প্রশ্ন তুলেছেন, হাথরস, উন্নাও, মণিপুরে মহিলাদের যখন নির্যাতন করা হয়েছে, তখন কেন্দ্রীয় সরকার ক’টা দল পাঠিয়েছে? বিজেপি, সিপিএম ক’টা দল পাঠিয়েছে? তাঁর কথায়, ‘‘বাংলায় ইঁদুর কামড়ালেও ৫৫টি দল পাঠান। আমাকে যা খুশি বলুন, কিছু যায়-আসে না। আমি জীবন্ত লাশ হয়ে গিয়েছি মার খেতে খেতে।’’
মমতা বলেন, ‘‘যে যেখানে কর্মরত, তাঁদের উচিত, নিজের ভাই-বোনকে দেখে রাখা। একটা বোনকে বিপদে ফেলে শুধুমাত্র ভাঙচুর, ঠিক নয়। আমি জানি, সিপিএম, বিজেপি আরজি করে ভাঙচুর করেছে। নাটক করেও যখন শেষ হয়নি। সাধারণ মানুষের প্রতিবাদকে কুর্নিশ জানাই। মা-বোনদের। নিশ্চয়ই তাঁরা ঠিক কাজ করেছেন বলে মনে হয়। রাত ১২টার পরে ডিওয়াইএফআই নিয়েছে দলের পতাকা, বিজেপি নিয়েছে জাতীয় পতাকা। জাতীয় পতাকা রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা যায় না। এই পতাকা নিয়ে গুন্ডাগিরি করা যায় না। এটা বন্ধ করা উচিত।’’
মমতা এক এক করে অনিতা দেওয়ান, তাপসী মালিকের ঘটনা মনে করান। তিনি নাম না করে সিপিএমকে খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘‘এ সব কার আমলে হয়েছিল? বাঁতলা থেকে ধানতলা? কোচবিহারের নার্স বর্ণালী দত্তকে খুন কার আমলে হয়েছে? নন্দীগ্রামে কার আমলে গুলি চলে? গণধর্ষণ হয়? রাজারহাটের ঘটনা? বাংলা জুড়ে কঙ্কাল পড়ে রয়েছে। তাদের মুখে এত বড় কথা শোভা পায় না। পরিবারকে সমবেদনা জানালে কিছু বলতাম না।’’ এর পর বিজেপি শাসিত গুজরাতে গণধর্ষণ, উন্নাও, হাথরসের কাণ্ড, উত্তরাখণ্ডে নার্সকে ধর্ষণ করে খুন, মধ্যপ্রদেশের খুন, মণিপুর বিবস্ত্র করে হাঁটানোর ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘এগুলো কার আমলে হয়েছে?’’ দর্শকাসন থেকে ভেসে আসে উত্তর, ‘‘বিজেপি’’। তিনি জানান, বাংলায় নারী নির্যাতন হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ জন্য ফাঁসির দাবিও তোলা হয়েছে।
মমতা জানালেন, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন অসুস্থ ছিলেন, তখন তাঁকে বেশ কয়েক বার বাড়িতে দেখতে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর খবর পেয়ে গিয়েছিলেন বাড়িতে। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মন্ত্রী সব সময় ছিলেন। হাজরায় যখন আমায় মেরে ফেলতে গিয়েছিল, কে ছিল ক্ষমতায়? ১৯৯২ সালে দাঙ্গায় যখন মানুষ মারা গিয়েছিলেন, আমি রাইটার্সে গিয়ে জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবুকে বলি, বলুন, কিছু করতে হবে? আমি হিন্দু এবং মুসলিম এলাকায় যাই। ছ’দিন ধরে রাস্তায় ঘুরে রিলিফ দিই। সিপিএম ছিল না।’’
মমতা জানান, ছাত্রছাত্রীদের সব দাবি মানা হয়েছে। ডগ স্কোয়াড গিয়েছে, ভিডিয়োগ্রাফি করে ময়নাতদন্ত হয়েছে। ফরেন্সিক পরীক্ষা হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘যা যা দরকার, পুলিশ করেছে। সারা রাত ঘুমায়নি পুলিশ। আমিও রাত ২টো পর্যন্ত খোঁজ নিয়েছি। দেহ যখন বাড়িতে পৌঁছতে যাচ্ছিল, এক বিজেপি নেত্রী মাঝপথে বাবা-মাকে নামিয়ে দেন। পুলিশ হস্তক্ষেপ করে। তালতলা থানায় এফআইআর হয়। আমি বলেছিলাম, যত ক্ষণ না শেষকৃত্য হবে, খবর দেবে। আমি রাত জেগে খোঁজ নিয়েছি। আমি রাজনীতি করলেও তার আগে আমি মানুষ। ঘটনায় জ্বলে যাচ্ছিলাম।’’
মমতা জানালেন, আরজি করে ঘটনার প্রথম দিন থেকে তিনি পদক্ষেপ করেছেন। রাজ্য পুলিশকে ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথম দিন থেকে বলছি, দোষীদের শাস্তি চাই। এই ঘটনাকে সমর্থন করি না। ফাঁসি হোক। রাজ্য সরকার ফাঁসির পক্ষে। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছিল। ঘটনা হয় শুক্রবার। আমি তখন ঝাড়গ্রামে। ফেরার সময় পুলিশ কমিশনারের মেসেজ পাই। তিনি ঘটনার বিবরণ দেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। আমি তাঁদের বলি, দোষীদের ফাঁসি যাতে হয়, রাজ্য সরকার সেই ব্যবস্থা করবে। সোমবার আমি ওদের বাড়ি যাই। মেয়েটির কাজ ছিল বলে আগে যাইনি। কলকাতা পুলিশের কমিশনারকে নিয়ে গিয়েছিলাম। তদন্ত শুরু হলেও সে বিষয় প্রকাশ করা যায় না। তাঁর মৃতদেহ দেখাতে পারে না।’’