বছর দেড়েক আগে ফেসবুকে নিজের ছবি ও অশালীন মন্তব্য-সহ একটি প্রোফাইল খুঁজে পেয়েছিলেন কল্যাণীর এক তরুণী। স্থানীয় থানায় যোগাযোগ করার পরে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সিআইডির কাছে। ভবানী ভবনে সিআইডি দফতরে এসে তিনি জানতে পারেন, তদন্ত শুরুর আগে স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করতে হবে। দু’-তিন দিন ভোগান্তির পরে স্থানীয় থানাতেই অভিযোগ দায়ের করেন তিনি।
ওই তরুণী একা নন। সাইবার অপরাধের অভিযোগ জানাতে গিয়ে থানা ও ভবানী ভবনে ঘুরে বেড়ানোর এই তালিকায় রয়েছেন বারাসতের এক তরুণী কিংবা বীরভূমের সর্বস্ব হারানো এক প্রৌঢ়ও।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য যেখানে বলছে, সারা দেশ জুড়েই সাইবার অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে, সেখানে এই অপরাধ দমনে রাজ্য পুলিশের এমন হাল কেন? রাজ্য পুলিশের একাংশ এর জন্য পরিকাঠামোর অভাবকেই দায়ী করছেন। তার ফলে নাকাল হতে হচ্ছে অভিযোগকারীদের।
রাজ্য পুলিশের কর্তাদের অনেকে অবশ্য বলছেন, সাইবার অপরাধ ঠেকাতে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন কমিশনারেটে সাইবার থানা কিংবা শাখা গড়া হয়েছে। এ বারে সাইবার অপরাধ দমনে পূর্ণাঙ্গ থানা গড়ার পথে এগোচ্ছে সিআইডিও।
রাজ্য পুলিশের এক কর্তা জানান, সিআইডির সাইবার শাখাকে থানায় রূপান্তরিত করার প্রস্তাব নবান্নে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে সেটাই হবে সিআইডির প্রথম থানা। থানা হলে ওই দফতরে ২৪ ঘণ্টা পুলিশকর্মী এবং অফিসারেরা ডিউটিতে থাকবেন।
কিন্তু এই নতুন থানা গড়া হলেও সাধারণ মানুষের কতটা সুরাহা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। পুলিশের একাংশই বলছেন, সাইবার অপরাধ দমনে রাজ্য পুলিশের পরিকাঠামোই নেই। নেই সাইবার অপরাধ তদন্তের যথার্থ প্রশিক্ষণও। সে ক্ষেত্রে ঢাকঢোল পিটিয়ে থানা গড়ার প্রয়োজনীয়তা কী, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাইবার অপরাধের তদন্তের জন্য দেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইন তৈরি করা হয়েছে। এই আইনে মামলা করা হলে কঠোর শাস্তির সুযোগ থাকে। কিন্তু ইন্সপেক্টর বা তার উপরের পদমর্যাদার অফিসারেরাই এই তদন্ত করতে পারেন। এ রাজ্যের বেশির ভাগ সাইবার থানায় এক জন ইন্সপেক্টর থাকেন। পুলিশ সূত্রের খবর, সাইবার থানা হলেও তদন্তের ভার এড়াতে এই ধরনের অপরাধে ফৌজদারি দণ্ডবিধি (আইপিসি) অনুযায়ী মামলা শুরু করা হয়। তার ফলে সাব-ইন্সপেক্টররা তদন্ত করেন। সিআইডি সূত্রের খবর, তাঁদের নতুন থানাতেও এক জন ইন্সপেক্টর থাকবেন।
সিআইডি সূত্রের খবর, সাইবার শাখায় কর্মী-অফিসার কম থাকায় এমনিতেই তদন্তের ভারে জর্জরিত তাঁরা। ইন্সপেক্টরের অভাব থাকায় বেশির ভাগ সাইবার অপরাধে আইপিসি-তে মামলা করেন সাইবার শাখার অফিসারেরা।
এখানেই প্রশ্ন তুলছেন সাইবার আইন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের একাংশ বলছেন, ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে তদন্ত করলেও সাইবার মামলা সামলানোর বিশেষ প্রশিক্ষণ দরকার অনেক সাব-ইন্সপেক্টরের থাকে না। তাতে মামলার ক্ষতি হয়। পুলিশের একাধিক প্রতিষ্ঠানে সাইবার আইনের শিক্ষক বিভাস চট্টোপাধ্যায়ও বলছেন, “অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ অফিসারদের সাইবার অপরাধ বা তদন্ত সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকে না। তার ফলে এই ধরনের তদন্তে বড় ফাঁক থেকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।”
প্রশ্ন উঠেছে, সিআইডির সদর দফতরে থানা তৈরির কার্যকারিতা নিয়েও। পুলিশেরই একাংশ বলছে, প্রত্যন্ত এলাকাতেও এখন ইন্টারনেট, স্মার্টফোন পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু রাজ্য পুলিশের যা পরিকাঠামো, তাতে প্রত্যন্ত এলাকার থানায় সাইবার অপরাধের অভিযোগ নেওয়ার মতো অফিসারই নেই। বারাসতের ওই তরুণী বলছেন, “থানায় অভিযোগ জানানোর ছ’মাস পরেও চার্জশিটের প্রতিলিপি তৈরি করেনি পুলিশ। ভবানীভবনে দৌড়েও বিশেষ লাভ হয়নি।” বীরভূমের এক প্রৌঢ়ের সঞ্চয়ের টাকা সাইবার জালিয়াতেরা হাতিয়ে নেওয়ার পরে তাঁকে স্থানীয় থানার অভিযোগের চিঠি নিয়ে সিআইডিতে আসতে হয়েছিল। অনেকেই বলছেন, সিআইডিতে থানা তৈরি হলে তো স্থানীয় পুলিশ অভিযোগ নিতেই চাইবে না। সে ক্ষেত্রে কোচবিহারের লোককে কলকাতায় আসতে হলে দুর্ভোগ আরও বাড়বে।
সিআইডির কর্তারা বলছেন, থানাগুলিকে এই ধরনের অভিযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় হতে বলা হবে। পাশাপাশি, প্রতি জেলায় সিআইডির যে শাখা অফিস রয়েছে, সেখানেও অভিযোগ জানানো যাবে। সেই অভিযোগ সদর দফতরে পাঠাবেন কর্মীরা। নাগরিক সুবিধার খাতিরে সিআইডি সাইবার থানা তৈরির কথা বললেও অনেকেই কিন্তু এতে ‘সিঁদুরে মেঘ’ দেখছেন। মুখ্যমন্ত্রীর ব্যঙ্গচিত্র ইমেলে ফরোয়ার্ড করায় অম্বিকেশ মহাপাত্রের গ্রেফতারের ঘটনা কেউ ভোলেনি এখনও। সাইবার জগতে সরকারের সমালোচনাও ক্রমশ বাড়ছে। তাতে রাশ টানাটাই সাইবার থানার মূল কাজ হবে না তো?
প্রশ্নটা উঠছে পুলিশের অন্দরেই।