মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।
মালদহের পাকুয়াহাটের ঘটনা নিয়ে মুখ খুললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চুরির অভিযোগে দুই মহিলাকে ‘বিবস্ত্র’ করে মারধরের ঘটনাকে তিনি ব্যাখ্যা করলেন ‘মেয়েদের মধ্যে মারামারি’ বলে। গোটা ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে পুলিশের একাংশের ভূমিকা। বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রী মমতাই এ রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী। মণিপুরকাণ্ড নিয়ে জাতীয় স্তরে বিজেপিকে যখন লাগাতার বিঁধে চলেছে বিরোধীরা, সেই সময় বাংলায় মালদহের ঘটনা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে নিশানা করতে শুরু করেছে গেরুয়া শিবির। মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিও করেছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তার প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার বিধানসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে মমতা জানালেন, মালদহের ঘটনায় পুলিশ পদক্ষেপ করেছে। গ্রেফতারও করা হয়েছে।
কোথাও রাতভর অবস্থান, কোথাও আবার মিছিল-পাল্টা মিছিল— পাকুয়াহাটে মহিলাদের উপর নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে গত রবিবার থেকে তেতে রয়েছে মালদহ ও দক্ষিণ দিনাজপুর। মণিপুরের প্রসঙ্গ টেনে পাকুয়াহাটের ঘটনায় রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তুলে পথে নামেন বিজেপির নেতা-নেত্রীরা। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যে প্রকাশ্যেই নারী নির্যাতন হচ্ছে। মহিলাদের বিবস্ত্র করে মারধর করা হচ্ছে। অথচ মুখ্যমন্ত্রী কোনও প্রতিক্রিয়া না-দিয়ে মণিপুরে গিয়ে লড়ার কথা বলছেন। পাকুয়ার ঘটনার নিন্দা করলেও মণিপুরের সঙ্গে তার তুলনা টানতে অবশ্য নারাজ বাম-কংগ্রেস। অন্য দিকে, তৃণমূলের অভিযোগ, মণিপুরের ঘটনা ধামাচাপা দিতে বিজেপি মালদহের ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করছে। এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় বলেন, ‘‘মালদহে একটা ঘটনা ঘটেছিল। চুরি করতে গিয়েছিল। ওটা মেয়েদের-মেয়েদের মধ্যে মারামারি। গ্রেফতারও করা হয়েছে।’’
গত শুক্রবার রাতে মালদহের বামনগোলার পাকুয়াহাটে চোর সন্দেহে দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে গণপ্রহারের অভিযোগের ভিডিয়ো নেটমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেই ভিডিয়োর সত্যতা আনন্দবাজার অনলাইন যাচাই করেনি। স্থানীয় সূত্রে দাবি, বামনগোলার সাপ্তাহিক হাটে গিয়েছিলেন দুই মহিলা। দরাদরির সময় তাঁরা আনাজ বিক্রেতার টাকা ছিনিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। হাটের ব্যবসায়ীরা তাঁদের ধরে মারধর করেন। সেই ঘটনা নিয়ে হইচই হতেই পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু করে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে। তার মধ্যে তিন জন মহিলাও রয়েছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, দুই ‘নির্যাতিতা’কেও পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। গণপ্রহারের ঘটনার ২৪ ঘণ্টা আগে বিজেপির আন্দোলনে বামনগোলার নালাগোলা ফাঁড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় ওই দুই ‘নির্যাতিতা’কে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেখানেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নির্যাতিতার পরিবার এবং বিরোধীরা। এক নির্যাতিতার মেয়ে বলেন, ‘‘মা ও কাকিমা হাটে হাটে লেবু বিক্রি করেন। তাঁদের চোর সন্দেহে মারধর করা হয়েছে। পুলিশ উল্টে মা আর কাকিমাকে গ্রেফতার করল কেন?’’
ফাঁড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় দুই ‘নির্যাতিতা’কে গ্রেফতারি নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল পুলিশের একাংশের মধ্যেই। প্রশ্ন তুলেছিল রাজ্য মহিলা কমিশনও। প্রশ্ন উঠেছিল— ফাঁড়ি ভাঙচুরের মামলায় প্রাথমিক ভাবে কি নাম ছিল দুই নির্যাতিতার? না কি পরে দু’জনের নাম জুড়ে দেওয়া হয়? মহিলাদের নির্যাতনের সময় কাছাকাছি থাকা সিভিক ভলান্টিয়ারদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এই সব বিষয় নিয়ে পুলিশের কাছে রিপোর্টও চেয়ে পাঠিয়েছে রাজ্য মহিলা কমিশন। তার প্রেক্ষিতে পুলিশ সুপার প্রদীপকুমার যাদব বলেন, ‘‘রাজ্যের মহিলা কমিশনকে রিপোর্ট দেওয়া হবে। মহিলাদের মারধরের অভিযোগে, ভিডিয়ো ফুটেজ খতিয়ে দেখে আরও কয়েক জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টাও চলছে।’’ এই টানাপড়েনের মধ্যে গত সোমবার মালদহের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের (সিজেএম) আদালত দুই ‘নির্যাতিতা’র জামিন মঞ্জুর করে।
গণপ্রহারের ঘটনায় শুধু অভিযুক্তদেরই নয়, ফাঁড়ির পুলিশ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি তুলেছে পাকুয়াহাটকাণ্ডের দুই ‘নির্যাতিতা’ই। গত মঙ্গলবার রাতে মেল মারফত পুলিশের কাছে গোটা ঘটনার রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও। পুলিশ এখনও পর্যন্ত কী কী পদক্ষেপ করেছে, রিপোর্টে সবই উল্লেখ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘটনাচক্রে, এর পরেই বুধবার, ঘটনার পাঁচ দিন পর পাকুয়াহাট ফাঁড়ির ওসি রাকেশ বিশ্বাস, এক জন সাব-ইনস্পেক্টর এবং এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টরের বিরুদ্ধে বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন জেলা পুলিশ সুপার। তিনি জানান, কারও কোনও গাফিলতি প্রমাণিত হলে, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে। সেই আবহেই বৃহস্পতিবার মমতা বিধানসভায় ওই মন্তব্য করেন।