২১ মে, ২০১০। দার্জিলিঙের ক্লাবসাইড রোডে হামলার পরে লুটিয়ে পড়েেছন রক্তাক্ত মদন তামাঙ্গ।—ফাইল চিত্র।
গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নাড়িয়ে দিল পাঁচ বছর আগে দার্জিলিং কাঁপানো একটি খুনের ঘটনা!
গোর্খা লিগ নেতা মদন তামাঙ্গ হত্যা মামলায় সিবিআইয়ের চার্জশিটে এ বার চলে এল মোর্চা-প্রধান বিমল গুরুঙ্গ-সহ দলের প্রথম সারির একাধিক নেতার নাম!
এই ‘হাই-প্রোফাইল’ মামলার প্রথম তদন্তকারী সংস্থা সিআইডির চার্জশিটে অবশ্য সন্দেহভাজন হিসেবে বড় মাপের কোনও মোর্চা নেতার নাম ছিল না। তা নিয়ে রাজনীতি, চাপ-পাল্টা চাপের অভিযোগও কম ওঠেনি মাঝের বছরগুলিতে। তদন্তভার হাতে নেওয়ার পরে শুক্রবার সিবিআইয়ের দেওয়া চূড়ান্ত সংযোজিত (ফাইনাল সাপ্লিমেন্টারি) চার্জশিটে কিন্তু যুক্ত হল গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ)-এর প্রধান বিমল গুরুঙ্গ, তাঁর স্ত্রী নারী মোর্চার নেত্রী আশাদেবী, রোশন গিরি, হরকাবাহাদুর ছেত্রী-সহ ২৩ জনের নাম। এঁদের সকলের বিরুদ্ধে মদন তামাঙ্গকে হত্যা, হত্যার ষড়যন্ত্র, তথ্য-প্রমাণ লোপাটে যুক্ত থাকার সাক্ষ্য-প্রমাণ মিলেছে বলে সিবিআইয়ের দাবি। মোর্চা নেতাদের বিরুদ্ধে সেই সব ধারাই চার্জশিটে দিয়েছে সিবিআই।
শুক্রবার দুপুরে কলকাতার বিচার ভবনে নগর দায়রা আদালতের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য বিচারকের এজলাসে চার্জশিট জমা দিয়েছেন সিবিআইয়ের আইনজীবী অরুণ ভগত। দুপুর পর্যন্ত মোর্চার শীর্ষ নেতারা অধিকাংশই জিটিএ-র প্রতি বঞ্চনা ও আলাদা গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি নিয়ে হইচই করেছেন। রাতে চার্জশিটের খবর পৌঁছতেই তাঁরা দরজায় খিল এঁটেছেন। বেশির ভাগেরই টেলিফোন বন্ধ। যাঁদের ফোন বাজছে, তাঁদেরও অধিকাংশ হয় ফোন ধরেননি, অথবা কেটে দিয়েছেন। কারণ চার্জশিট জমার খবর জেনেই গোর্খা লিগের সাধারণ সম্পাদক প্রতাপ খাতি-সহ পাহাড়ের মোর্চা-বিরোধী দলগুলির নেতারা দাবি করেছেন— যাঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হল, তাঁরা পাহাড়ের প্রভাবশালী ব্যক্তি। এঁদের গ্রেফতার করে জেলে রেখে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। চার্জশিটে নাম থাকায় অভিযুক্তদের গ্রেফতারে আইনি বাধা নেই বলে দাবি করেছেন পেশায় আইনজীবী প্রতাপবাবু। দাঁতে দাঁত চেপে আইনি লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন মদনের স্ত্রী ভারতী তামাঙ্গ। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘চার্জশিট দিতে অনেক দেরি হয়ে গেল। তবে সুবিচারের পথেই তদন্ত এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এ বার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ করতে হবে।’’
মোর্চার আইনজীবী সেলের নেতা শেষমণি গুরুঙ্গ অবশ্য বলেছেন, ‘‘নথিপত্র সব হাতে পাই। বিচার বিভাগের ওপর আমাদের আস্থা রয়েছে। আমরা আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ করব।’’ মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা একান্তে বলেন, ‘‘চার্জশিটে নাম থাকা মানেই তো আর দোষী সাব্যস্ত হওয়া নয়। অতীতে দেশের অনেক বড় বড় নেতার নাম চার্জশিটে থাকলেও পরে তাঁরা নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন।’’ এই নেতার মন্তব্য— বিমল গুরুঙ্গ পাহাড়ের প্রশাসনিক প্রধান। উনি কোথাও পালাবেন না। সেটা মাথায় রেখেই সকলকে পদক্ষেপ করতে হবে। আবার শুক্রবার রাতে মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা তথা কালিম্পঙের বিধায়ক হরকাবাহাদুর ছেত্রী বলেন, ‘‘পাহাড়-সমতলের সকলে আমাকে চেনেন, জানেন। আর কে কী করেছে জানি না, আমি অন্তত এই খুনোখুনির মধ্যে নেই! জেরায় সিবিআইকেও সে কথা বলেছি। এখন তো সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়েই আমার সন্দেহ হচ্ছে!’’
মোর্চার অন্দরের খবর— যে ভাবে হোক, গ্রেফতারি এড়ানোই এখন অভিযুক্ত নেতাদের প্রধান লক্ষ্য। সে জন্য বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মোর্চা নেতারা কলকাতা ও দিল্লির কয়েক জন দুঁদে আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। আদালতে আত্মসমর্পণ করলে জামিন মিলবে কি না, তা-ও জানতে চেয়েছেন তাঁরা। গুরুঙ্গের কয়েক জন অনুগামী জানান, কেন্দ্র ও রাজ্যের সমস্ত রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে স্বস্তির ব্যবস্থা করতে মরিয়া দলের নেতারা।
কী হয়েছিল পাঁচ বছর আগে?
গোর্খা লিগ সভাপতি মদন তামাঙ্গকে ২০১০-র ২১ মে দার্জিলিঙের ক্লাব সাইড রোডে কুপিয়ে খুন করা হয়। তামাঙ্গ সে দিন দার্জিলিঙের সভায় গুরুঙ্গ ও তাঁর ঘনিষ্ঠর ধনসম্পত্তি ও দুর্নীতির বিষয়ে নানা তথ্য খোলাখুলি জানাবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন। সভা শুরু হলে হামলা চালায় দুষ্কৃতীরা। দেহরক্ষী পুলিশের সামনেই ভোজালির কোপ দিয়ে মদন তামাঙ্গের মুণ্ডু ধড় থেকে প্রায় আলাদা করে দিয়ে আততায়ীরা পালায়। ঘটনার পরে গুরুঙ্গ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে খুন, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করে গোর্খা লিগ। কিন্তু মোর্চা নেতারা নিজেদের নির্দোষ বলে দাবি করেন। মহাকরণ থেকে তামাঙ্গ হত্যাকাণ্ডের সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।
তদন্তে নেমে মোর্চা নেতা নিকল তামাঙ্গ-সহ কয়েক জনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। কিন্তু ওই বছরই ২২ অগস্ট শিলিগুড়ির পিনটেল ভিলেজে সিআইডি হেফাজত থেকে উধাও হয়ে যান নিকল তামাঙ্গ। তিনি আজও অধরা। সিআইডির চার্জশিটে নিকল-সহ ৩১ জনের নাম ছিল। কিন্তু গুরুঙ্গ, তাঁর স্ত্রী আশা, রোশন গিরি বা জিএলপি (গোর্খাল্যান্ড পার্সোনেল)-র প্রধান অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আলের নাম ওই চার্জশিটে না-থাকায় ক্ষোভ দানা বাঁধে। সিবিআই তদন্তের দাবিতে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন মদন তামাঙ্গের স্ত্রী ভারতী তামাঙ্গ। রায়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। পরে তদন্তে টালবাহানার অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টেও যান ভারতী দেবী। বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠনের আর্জি জানান তিনি। সিআইডির চার্জশিটে নাম থাকা দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দিলকুমার রাই নামে জামিনে মুক্ত এক জন খুন হয়েছিলেন বলে অভিযোগ।
সিবিআই সূত্রের খবর, গোড়ায় তদন্তে ঢিলেমি থাকলেও পরে প্রচুর নথি, মোবাইলের কল রেকর্ড সংগ্রহ করেন অফিসারেরা। খুনের চক্রান্তের সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলেছে বলেও দাবি তাঁদের। মোর্চার কিছু প্রথম সারির নেতা, তামাঙ্গের দেহরক্ষী পুলিশ, এমনকী প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানও রেকর্ড করে সিবিআই। সিবিআইয়ের এক মুখপাত্রের দাবি— যাবতীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে দেখা যাচ্ছে, তামাঙ্গকে হত্যার ঘটনায় গুরুঙ্গদের মতো মোর্চার শীর্ষ নেতারাও জড়িত। সে জন্যই আগের চার্জশিটে থাকা নামগুলির সঙ্গে গুরুঙ্গ-সহ এই ২৩ জনের নাম যুক্ত করে আদালতে অতিরিক্ত চার্জশিট পেশ করা হয়েছে।