নেট-নাগরিকদের রসিকতা।
জীবনভর লালহলুদ জার্সি পরে রামবাহাদুরের রেকর্ড ভাঙতে চেয়েছিলেন গৌতম সরকার। সেই তিনিই ইস্টবেঙ্গলে সাসপেন্ড হয়ে অভিমানে মোহনবাগানে সই করলেন। সেই দলত্যাগে আইএফএ-র গলিতে সোডার বোতল বৃষ্টি হয়েছিল।
তবু এখনকার ভোটযুদ্ধের দলবদলকেই ঢের জটিল মনে হচ্ছে গৌতমের। “নিম্নবিত্ত ঘরের ফুটবলাররা একটু বেশি টাকা পেলে দল ছাড়া দোষের নয়! ফুটবলের মতো রাজনীতিতে দল পাল্টানো দেখে খুব খারাপ লাগছে!” সবুজ-মেরুন, লাল-হলুদ দুই জার্সিতেই সমান সফল, দু’দলেরই ক্যাপ্টেন গৌতম টাকা নয় ক্লাবকেই প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলেন। এক বার বাড়ি বয়ে আসা চুনী গোস্বামীর অনুরোধেও ইস্টবেঙ্গল ছাড়েননি। আবার টানা মোহনবাগানে খেলার সময়ে সিঁথির বাড়িতে মশারিতে ঢুকে পড়া লালহলুদ কর্তা কি নগদ লাখো টাকার থলে হাতে আসা মহামেডান কর্তাকেও ফিরিয়ে দেন ভালবাসার জোরে। এ কালে রাজনৈতিক দলের প্রসঙ্গে ‘পরিবার’ ও ‘মা’ কথাগুলো আকছার শোনা যায়। কিন্তু দলীয় কুশীলবেরা মানছেন, ময়দানে ক্লাবের প্রতি ভালবাসার সেই আবেগও রাজনীতির ময়দানে এখন উধাও।
হিন্দি-বলয়ে দলবদলু নেতাদের নাম ‘আয়ারাম গয়ারাম’। ১৯৬৭-তে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে ১৭ জন বিধায়ক প্রফুল্ল ঘোষের সঙ্গে নতুন মোর্চা গড়েন। সে-ছিল সরকার ভাঙাগড়ার তাগিদ। ভোটের গন্ধে জল মেপে কৃষ্ণ বা শুক্লপক্ষ বাছাইয়ের সূক্ষ্ম বুদ্ধি এতটা জাঁকিয়ে বসেনি। ২০২১-এর ভোট-রাজনীতিতে শিরোনামে ‘বেসুরো’র দল। তাঁদের মুখের লব্জ, ‘দলে থেকে কাজ করতে পারছি না’!
রসিক-বাঙালির নেট-আমোদেও এই বেসুরোরাই নায়ক। কখনও বিভীষণ এসে রামকে বলছেন, দাদার দলে থেকে কাজ করতে পারছিলাম না। বা ‘জটায়ুর ফেলুদা-শিবির ত্যাগ’ বলে মিম হচ্ছে। লালমোহনবাবুর মগনলাল মেঘরাজের দলে ‘কারিয়াকর্তা’ (কার্যকর্তা) হওয়ার ঝোঁক দেখা যাচ্ছে।
বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য বা কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান তৃণমূলকেই দুষছেন। শমীকের কথায়, ওদের দলের এক নেতাই বলেন, টিএমসি চলন্ত ট্রেন। যার যখন স্টেশন আসবে, নেমে যাবে।” মান্নানের অভিযোগ, “সিপিএমের নানা দৌরাত্ম্য থাকলেও ওরা দল ভাঙাত না। তৃণমূল ধারাবাহিক ভাবে দল ভেঙেছে। এখন বিশ্বাসঘাতকতায় জেরবার।” অতীতে বার বার দল বদলেছেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, ‘‘তখন আলাদা পরিস্থিতি ছিল। এখন আদর্শ নেই। এরা দেখছে, দল বদলেও জেতা যায়।’’
তবু বেসুরে বাজার প্রবণতা নিছকই সাম্প্রতিক নয়। বাম রাজনীতির ভিতরেও মতাদর্শের লড়াই হয়েছে। দল, উপদল হয়েছে। ব্যক্তির ছায়া পড়েছে। বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনেও তার ছাপ পড়েছে। ঋত্বিক ঘটকের ‘কোমল গান্ধার’-এর কথা মনে করাচ্ছেন অর্থনীতির অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্য। নাটকের দলের টানাপড়েন, অন্তর্ঘাত সবই ছিল তাতে। বেসুরো অভিনেত্রী দেরিতে শো করতে আসছেন। আবহসঙ্গীতে ব্যাঙের ডাক মিশিয়ে শো পণ্ড হচ্ছে। এ সবই বৃহত্তর পটভূমির প্রতিফলন। ঋত্বিক নিজেও কমিউনিস্ট পার্টি থেকে মতাদর্শগত কারণে বিচ্ছিন্ন হন।
তা-বলে দল ছেড়ে অন্য মতাদর্শে হাত মেলানোর ঘটনা কম। এখন লাল পতাকা ছেড়ে মমতা-বিরোধিতায় গেরুয়া হচ্ছেন কোনও কোনও বামপন্থী। মুকুল রায়রা বলছেন, দল ভাঙানো রাজনীতির অঙ্গ। সৌরীনবাবুর মতে, “আদর্শ নয়, ব্যক্তিগত লাভটাই দেখছি সব!”
আর রাজ্য দেখছে, নতুন নাটক। প্রায় ফি দিন, কেউ মাইক্রোফোন হাতে বলে উঠছেন, ‘‘দলে থেকে কাজ করতে পারছিলাম না।’’