নীলবাড়ি জয়ের লক্ষ্যে কড়া অবস্থান বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের।
বেশি বাছবিচার করলে চলবে না। নতুনদের সঙ্গে নিতে হবে। নতুনদের সঙ্গে নিয়ে চলতেও হবে। রাজ্য বিজেপি-কে এমনই নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। একই সঙ্গে সতর্কীকরণ— অন্য রাজনৈতিক দল থেকে বিজেপি-তে কাউকে নেওয়ার ব্যাপারে শীর্ষনেতৃত্ব যা সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটা মানতে হবে। ‘মনে’ নিতে না পারলেও ‘মেনে’ নিতে হবে। ছোট-বড়-মাঝারি কোনও নেতার কোনও ক্ষোভ-বিক্ষোভ-বিদ্রোহ বরদাস্ত করা হবে না। কারণ, নীলবাড়ি দখলের লক্ষ্যে দলীয় সিদ্ধান্ত— ‘নীতির চেয়ে কৌশলে বেশি গুরুত্ব’। এবং এটাই আপাতত দলের নীতি।
একটা সময় পর্যন্ত যে কোনও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দলে নেওয়ার ক্ষেত্রে নীতিগত বিরোধিতা ছিল বিজেপি-র। এখনও দলের অনেকের মধ্যে সেই বাধো-বাধো মনোভাব রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী কৌশল ঠিক করতে সে সব আপত্তি ও বিরোধিতাকে গুরুত্ব দিতে রাজি নন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। ওই বিষয়ে কোনও আপত্তি বা ভিন্নমত বরদাস্ত করতে চাইছেন না অমিত শাহ-কৈলাস বিজয়বর্গীয়রা। সেই কঠোর মনোভাব বুঝিয়ে দিতে দলীয় বৈঠকে শুধু মুখে বলা নয়, পদক্ষেপ করাও শুরু হয়েছে।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্য বিজেপি-র কর্তৃত্ব অনেক আগেই নিয়ে নিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে বাংলায় একের পর এক ভিনরাজ্যের নেতাদের পাঠিয়েছেন অমিত। রাজ্য বিজেপি সূত্রের খবর, এখন সংগঠনের রাশ ধরার ব্যাপারটা আরও ‘কেন্দ্রীভূত’। মূলত রাজ্যের পর্যবেক্ষক কৈলাসের হাতেই পুরো দায়িত্ব। তিনিই ঠিক করবেন নির্বাচনী লড়াইয়ে বাংলায় কোন পথে এগোবে দল। রাজ্যের এক নেতার কথায়, ‘‘কৈলাসজিকে এই গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন খোদ অমিতজি। আর কৈলাস’জির নির্দেশ, যাঁকে যেটুকু কাজ করতে বলা হয়েছে সেটুকুই করা। যাঁর যা দায়িত্ব, তিনি সেটুকুই পালন করুন। অন্যের বিষয়ে বা অন্য বিষয়ে মাথা ঘামানোর কোনও দরকার নেই।’’ সেই নির্দেশের সঙ্গেই কৈলাস রাজ্য নেতাদের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ‘নীতির চেয়ে কৌশলে গুরুত্ব’ বিষয়টি ঠিক কী।
আরও পড়ুন: এবার বিজেপি-তে যাচ্ছেন তৃণমূলের ছাত্রনেতা সুজিত
তৃণমূল-সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে ইতিমধ্যেই অনেকে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন। বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে বলেও দাবি করছে বিজেপি। সেই ‘যোগদান’-এর ক্ষেত্রে কোন নেতা কেমন, তার চেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে ভোট টানার ব্যাপারে সেই নেতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং নিজেরে এলাকায় কতটা ক্ষমতাশালী। এটাই আপাতত বিজেপি-র কৌশল। তৃণমূলের সাংগঠনিক শক্তিকে দুর্বল করার ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের জেলা স্তরের কোনও নেতা যদি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হন, তা হলে তাঁকে স্বাগত জানাবে বিজেপি। সংশ্লিষ্ট নেতাকে নিয়ে স্থানীয় কর্মীদের অমত বা অনুযোগ থাকলেও তার উপর গুরুত্ব দেওয়া হবে না। রাজ্য বিজেপি-র এক নেতা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই নয়া নীতির উদাহরণ দিয়ে বলছেন, ‘‘ধরা যাক তৃণমূলের কোনও এক নেতার উপর বিজেপি কর্মীদের ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু ওই নেতাকে দলে নিতে পারলে হাজার ভোট মিলতে পারে। সেক্ষেত্রে ওই নেতাকে বিজেপি-তে নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও বাধা দেওয়া চলবে না। তাঁকে স্বাগত জানাতেই হবে।’’ রাজ্য বিজেপি-র একাংশ মনে করছে, বিধানসভা নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও এই ‘কৌশল’-ই বজায় থাকবে। কে নতুন, কে পুরনো বিচার না করে কার জেতার সম্ভাবনা বেশি, সেটাই হবে প্রধান বিবেচ্য।
সম্প্রতি জিতেন্দ্র তিওয়ারিকে নিয়ে তেমন পরিস্থিতিই তৈরি হয়েছিল। তাতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন আসানসোলের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। তিনি নিজের ফেসবুক পেজে একটি লম্বা স্টেটাস এবং ভিডিও আপলোড করেন। যাতে তিনি স্পষ্টই বলেছিলেন, জিতেন্দ্র বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তই শিরোধার্য। কিন্তু ওই বিষয়ে তাঁর ‘ব্যক্তিগত আপত্তি’ রয়েছে। তিনি বিষয়টি মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না। বাবুলের অভিমত ‘সঙ্গত’ বলে প্রকাশ্যেই জানান রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ। এর পর জিতেন্দ্রকে দলে নেওয়ার বিষয়ে নিজেদের আপত্তি জানিয়ে সংবাদমাধ্যমে মুখ খোলেন দলের সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু ও মহিলা মোর্চার প্রধান অগ্নিমিত্রা পাল। এর পরে পরেই শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে বিজেপি-তে যোগ দেওয়া আলিপুরদুয়ারের প্রাক্তন সাংসদ দশরথ তিরকে এবং নাগরাকাটার তৃণমূল বিধায়ক শুক্রা মুন্ডাকে নিয়ে ক্ষোভের সুর শোনা যায়। ওই বিষয়ে প্রকাশ্যেই ক্ষোভপ্রকাশ করেন বিজেপি-র আলিপুরদুয়ার জেলা সভাপতি গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা এবং নাগরাকাটার মণ্ডল সভাপতি সন্তোষ হাতি।
আরও পড়ুন: ‘দানবের সঙ্গে হবে লড়াই মহামানবের’
সায়ন্তন থেকে সন্তোষ— সকলকেই শো-কজ করেন রাজ্যনেতৃত্ব। যদিও বাবুল এবং দিলীপের ক্ষেত্রে তেমনকিছু করা হয়নি। বস্তুত, যাঁদের শো-কজ করা হয়েছে, তাঁদের দিলীপের নির্দেশেই তা করা হয়েছে বলে জানানো হয়। চার পদাধিকারীকে শো-কজের চিঠি ধরানোই শুধু নয়, সেগুলি বিজেপি-র তরফেই প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হয়। এমনিতে এই ধরনের সাংগঠনিক চিঠির ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রাখে বিজেপি। কিন্তু এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশেই তা সংবাদমাধ্যমকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে রাজ্য বিজেপি-র এক নেতা জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় নেতারা চেয়েছিলেন কৌশলগত কারণেই চিঠি প্রকাশ্যে আনা হোক। তাতে ওই নেতাদের পাশাপাশি দলের সর্বস্তরেই বার্তা পৌঁছে দেওয়া যাবে। সকলকে বুঝিয়ে দেওয়া যাবে, নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাক্তিগত মতামত প্রকাশ করা যাবে না।’’ দলের নেতারা মনে করছেন, ওই ভাবেই দিলীপ এবং বাবুলকে ‘বার্তা’ দেওয়া হয়েছে। ঝি’কে মেরে বউকে শেখানোর মতো। এক নেতা জানাচ্ছে, সরাসরি বাবুল-দিলীপকে চিঠি না দেওয়া হলেও তাঁদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি এক তৃণমূল বিধায়কের বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ফেসবুকে আপত্তি জানিয়েছিলেন কয়েকজন দলীয় কর্মী। সেগুলিও ‘ডিলিট’ করানো হয়েছে রাজ্য নেতৃত্বের উদ্যোগে।
একদা তৃণমূলের দু’নম্বর মুকুল রায়ের বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার সময়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। দলের একাংশ মুকুলের যোগদানের সরাসরি বিরোধিতা করলেও তা কানে তোলেননি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। শোভন চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিতে যোগ দেওয়ার সময় ২০১৯ সালের অগস্টে এবং তার পরেও দিলীপ একাধিক বার ‘বিরূপ এবং লঘু’ মন্তব্য করেছিলেন। শোভনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তাঁর নাম না থাকায় চরম ‘ব্যথিত’ হয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন বৈশাখী। তখন দিলীপ মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘আমরা জানি যেমন ভাত-ডাল, তেমনই শোভনদা-বৈশাখীদি। আলাদা করে বলার কী আছে!’’ তবে রাজ্য বিজেপি-র এক নেতার বক্তব্য, ‘‘সে সব এখন অতীত। দলের আগাপাশতলা এখন নির্বাচনী কৌশল দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তাই দিলীপ’দাকে দিয়েই শোভনকে কলকাতা জোনের দায়িত্বে এবং বৈশাখীকে কমিটিতে আনা হয়েছে। সবটাই কেন্দ্রীয় নির্দেশে।’’
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ‘চাপে’ দিলীপও যে বদলাচ্ছেন, সে প্রমাণও মিলতে শুরু করেছে। ক'দিন আগেই জিতেন্দ্র-প্রশ্নে বাবুলকে সমর্থন জানানো দিলীপ বুধবার বলেছেন, ‘‘একদিন অর্জুন’দা (অর্জুন সিংহ) আর আমি সামনাসামনি লড়তাম। এখন উনি রাজ্য দলের সহ-সভাপতি আর আমি সভাপতি। একটা সময়ে শুভেন্দু অধিকারীর এলাকায় আমার গাড়ি ভাঙা হয়েছিল। ওঁর সঙ্গে সামনাসামনি লড়াই হত। এখন শুভেন্দু আর আমি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লড়ছি। সুনীল’দাকে (সাংসদ সুনীল মণ্ডল) হারানোর জন্য আমি প্রচারে গিয়েছিলাম। এখন সুনীলদা আমাদের সঙ্গে আছেন। আমরা কোনও ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে লড়ছি না। আমরা লড়ছি বাংলার জন্য।’’