কয়েক দিনের ব্যবধানে ঝাড়গ্রামে বৈঠক করে গিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি ও রাজ্য গোয়োন্দা পুলিশের ডিআইজি। পুলিশ সুপারও জানাচ্ছেন, অশান্তি রুখতে সতর্ক রয়েছে পুলিশ। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
ফাইল চিত্র।
‘নকল’কে ভর করে ফিরবে না তো ‘আসল’! জঙ্গলমহলের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এমনই আশঙ্কা করছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।
গত কয়েক দিনে ঝাড়গ্রাম-সহ জঙ্গলমহলের নানা প্রান্তে সিপিআই মাওবাদী লেখা পোস্টার মিলেছে। কখনও পাওয়া গিয়েছে ভুয়ো মাইন। মাওবাদীদের নামে বন্ধেও সাড়া মিলেছে লালগড়, বেলপাহাড়িতে। তবে এ সবের পিছনে খাঁটি মাওবাদীরা নেই, নিশ্চিত পুলিশ। পোস্টার লেখার ধরন, বয়ান, ভাষাজ্ঞান প্রকৃত মাওবাদীদের মতো নয়। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদেরও পর্যবেক্ষণ, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে একটি মহল এ সব করছে। তারা আদৌ মাওবাদী নয়। তবে তাদের কার্যকলাপে জঙ্গলমহলের শান্তির আকাশে অশনি সঙ্কেত দেখছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের মতে, ছদ্ম মাওবাদী কার্যকলাপে আখেরে ঝাড়খণ্ড-ছত্তীসগঢ়ের মাওবাদীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে সক্রিয় হয়েছে পুলিশও। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সন্দেহজনক গাড়ি থামিয়ে খানাতল্লাশিও শুরু হয়েছে। ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার বিশ্বজিৎ ঘোষ বলছেন, ‘‘কারা দুষ্কর্ম করছে আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। নজর রাখা হচ্ছে। কড়া পদক্ষেপ হবে।’’
সম্প্রতি গোয়েন্দাদের হাতে এমন কিছু প্রামাণ্য তথ্য এসেছে, যাতে পুলিশও নিশ্চিত যে একটি চক্র পরিকল্পিত ভাবে জঙ্গলমহলকে অশান্তির দিন ফেরাতে চাইছে। সূত্রের খবর, একটি গোপন বৈঠকের ভিডিয়ো পুলিশের হাতে এসেছে। পুলিশের দাবি, মাওবাদী নয় এমন কয়েকজনকে ওই ভিডিয়োয় বক্তব্য রাখতে দেখা গিয়েছে। পোস্টার ছড়িয়ে জঙ্গলমহলকে অশান্ত করারও কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু কারা করছে এ কাজ? গোয়েন্দাদের পর্যবেক্ষণ, পুনর্বাসন প্যাকেজে আত্মসমর্পণকারী সাড়ে সাতশো জন প্রাক্তন মাওবাদী চাকরি পেয়েছেন। মাওবাদী হানায় স্বজনহারা সাড়ে তিনশোজনকেও চাকরি দেওয়া হয়েছে। আর পুনর্বাসন প্যাকেজে চাকরির জন্য আরও ৭৫৬জনের আবেদন খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কিন্তু ওই সব আবেদনকারীদের বেশিরভাগই মাওবাদী কার্যকলাপে যুক্ত নয়। তা ছাড়া, অন্য কারণে মৃতের পরিজনরাও চাকরির আবেদন করেছেন, যাঁরা প্যাকেজের আওতায় পড়েন না।
নির্দিষ্ট কিছু সূত্র ধরে তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, চাকরির জন্য পুলিশের দরজায় ঘুরছে, এমন কয়েক জনই ভুয়ো পোস্টার ছড়াচ্ছে। কিছু বালি মাফিয়া, জমি-বাড়ির দালালও প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে মাওবাদী-আতঙ্ক তৈরি করছে। কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে রাজনৈতিক অন্তর্বিরোধের বিষয়ও। এক গোয়েন্দা অফিসার বলছেন, ‘‘চাকরি প্রার্থীদের কেউ কেউ পুলিশ-প্রশাসনকে চাপে রাখতে পোস্টার ছড়াচ্ছে। আবার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরেও ভয় দেখাতে কেউ কেউ ভুয়ো পোস্টার দিচ্ছে।’’ তৃণমূলের ঝাড়গ্রাম জেলা সভাপতি দেবনাথ হাঁসদার নালিশ, ‘‘জঙ্গলমহলে বিরোধীদের রাজনৈতিক জমি নেই। তাই বিভিন্ন মহলকে ব্যবহার করে অশান্তির পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা হচ্ছে।’’ বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্য সুখময় শতপথীর আবার ব্যাখ্যা, ‘‘মাওবাদীদের ব্যবহার করে তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছে। যে সব প্রাক্তন মাওবাদী সুযোগ-সুবিধা পাননি, তারাই তৃণমূলের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন।’’
তবে এই পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা ভিন্ রাজ্যের মাওবাদীরা করতে পারে, সেটাই চিন্তা। গোয়েন্দারা মনে করছেন, অবিলম্বে সতর্ক না হলে পরিস্থিতি বিগড়োতে পারে। কারণ, বাম আমলে ২০০৮ নাগাদ লালগড়ে স্থানীয়দের ক্ষোভ-বিক্ষোভ শুরুর সময় পুলিশ হাত গুটিয়ে ছিল। তার ফলেই জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকা মাওবাদী মুক্তাঞ্চল হয়ে গিয়েছিল। এ বার অবশ্য তৎপর রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকেও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে ঝাড়গ্রামে বৈঠক করে গিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি ও রাজ্য গোয়োন্দা পুলিশের ডিআইজি। পুলিশ সুপারও জানাচ্ছেন, অশান্তি রুখতে সতর্ক রয়েছে পুলিশ। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।