স্পিডবোটে ধরলা নদী পেরিয়ে বাঁশুয়াখামার ছিটমহলে গিয়ে শনিবার জাতীয় পতাকা তুললেন কোচবিহারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট শীতলকুমার বসু। ছবি: অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
ছিটমহল হস্তান্তর নিয়ে আবেগ এখন চরম পর্যায়ে। কিন্তু এর মধ্যেই পুনর্বাসনের টাকার অঙ্ক নিয়ে নতুন করে বিবাদ শুরু হয়েছে নরেন্দ্র মোদী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের মধ্যে।
বাংলাদেশের ছিটমহলগুলি থেকে আসা মানুষের পুনর্বাসনে ৩০০৮ কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মোদী সরকার। কিন্তু এখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে জানিয়েছে, তারা এ ব্যাপারে ৫০ কোটি টাকার বেশি দিতে পারছে না। ফলে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ রাজ্য সরকার। তবে রাজ্য সরকারের সঙ্গে জটিলতা যাতে বেশি দূর না গড়ায়, সে দিকে নজর রাখছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর সচিবালয়ের মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হয়েছে, কেন্দ্র আলোচনা করে বিষয়টির সমাধানে আগ্রহী। এ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লি এলে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী প্রধানমন্ত্রী। তার আগে বিষয়টি নিয়ে রাজনাথ সিংহ ও অরুণ জেটলির সঙ্গে কথা বলবেন মোদী।
স্থল সীমান্ত চুক্তি করতে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ঢাকায় গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার ঠিক আগেই রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে চিঠি দিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব এন সি গয়াল জানান, ছিটমহল বিনিময়ের জন্য পুনর্বাসনে দিল্লি ৩০০৮ কোটি টাকা দেবে। যদিও হিসেবনিকেশ করে রাজ্য সরকার এ জন্য প্রায় চার হাজার কোটি টাকা চেয়েছিল।
প্রশ্ন হল, সেই অবস্থান থেকে দিল্লি হঠাৎই সরে এল কেন? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্য, স্বাধীনতার ৬৮ বছর পরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এই ঐতিহাসিক স্থল সীমান্ত চুক্তি হয়েছে। এর ফলে ১৪ হাজার ২১৪ জন ছিটমহলবাসী ভারতীয় নাগরিকে পরিণত হলেন। আর ৩৬ হাজার ২১ জন বাংলাদেশের ভূখণ্ডেই থেকে যাচ্ছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলছে, শুধুমাত্র ৯৭৯ জন বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরতে চেয়েছেন। পুনর্বাসনের জন্য মাথাপিছু কেন্দ্র পাঁচ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছিল। কেন্দ্রের যুক্তি, সবাই না এসে যদি শুধু ৯৭৯ জন আসেন, তা হলে কেন্দ্রই বা কেন তিন হাজার কোটি দেবে? মাথাপিছু পাঁচ লক্ষ টাকা হিসেবে পুনর্বাসন বাবদ মোট খরচ ৫০ কোটি টাকার সামান্য কম।
নতুন করে এই জট ক্ষুব্ধ করে তুলেছে মমতাকে। তিনি এতে বঞ্চনার গন্ধ পাচ্ছেন। রাজ্য সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে পাল্টা জানিয়েছে, বিষয়টি শুধুমাত্র ব্যক্তিপিছু পুনর্বাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এতগুলি পরিবারকে এ দেশে নিয়ে এসে বসবাসের অনুকূল ব্যবস্থা করে দিতে পরিকাঠামোগত অনেক বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। পুনর্বাসনের পরে সীমান্তকে সব রকম ভাবে নিশ্ছিদ্র করতে হবে। সেতু তৈরি করতে হবে, বেড়া দিতে হবে, চেক পোস্ট তৈরি করতে হবে। ৯৭৯ জন তথা ২২২টি পরিবারের মধ্যে ১৪৬টি হিন্দু পরিবার। আবার ভারতে অবস্থিত ছিটমহল থেকে কেউই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে যাওয়াকে বেছে নিচ্ছে না। ওই এলাকার উন্নয়ন, কোচবিহারে অস্থায়ী বাসস্থান তৈরি করা এবং নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক সরকারি ব্যয় লুকিয়ে রয়েছে। রাজ্য সরকারের আরও যুক্তি, এখনই সকলে না এলেও পরবর্তী পর্যায়ে আরও লোক আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রের বক্তব্য, যখন যে রকম লোক আসবে, তখন সে রকম ভাবেই আর্থিক বরাদ্দ হতে পারে।
জটিলতা কাটাতে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে রাজ্য সরকার অভিযোগ জানিয়েছে। তার পরেই প্রধানমন্ত্রী আলোচনার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ছিটমহল বিনিময়ের পরে মোদী এ বার তিস্তা চুক্তির প্রস্তাব নিয়ে মমতার সঙ্গে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। ঢাকা সফরের সময়ে মমতা জানিয়েছিলেন, তিনি তিস্তা চুক্তির বিরোধী নন।
কিন্তু এই চুক্তির ফলে উত্তরবঙ্গে জলসঙ্কট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেই মনে করছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা মনে করেন, উত্তরবঙ্গ যদি বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পানীয় জলের সঙ্কট সৃষ্টি হয়, তা হলে কখনও তিস্তা চুক্তিতে সায় দেওয়া উচিত নয়। এই পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদী সরকারও উত্তরবঙ্গের জন্য একটি বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার কথা ভাবছেন। যাতে তিস্তা চুক্তির ফলে রাজ্য কোনও সঙ্কটের মুখে না পড়ে। কিন্তু নতুন মাথাব্যথা হল, প্রধানমন্ত্রী যখন তিস্তার আলোচনা চান, তখন স্থল সীমান্ত চুক্তি নিয়ে সঙ্কটের সৃষ্টি হলে পুরো বিষয়টিই জটিল হয়ে যাবে। এ কারণেই প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে মমতার কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে, তিনি যদি ১০, ১১ বা ১২ অগস্ট নাগাদ দিল্লি আসেন, তা হলে মুখোমুখি বসে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা হতে পারে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলছে, মুখ্যসচিবকে স্বরাষ্ট্রসচিব চিঠি দিলেও আসলে টাকাটা অনুমোদন করে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক। অর্থ মন্ত্রক যদি তাদের আগের প্রতিশ্রুতি বদলে টাকা কমিয়ে দিতে চায়, তা হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কী করবে? এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় জানাচ্ছে, অরুণ জেটলি ও রাজনাথ সিংহের আলোচনা করার পরে মমতার সঙ্গে বিবাদ মেটাতে সচেষ্ট হবেন মোদী।
শুধু বাংলাদেশ নয়, মমতা দিল্লি এলে অরুণ জেটলি হলদিয়া পেট্রো কেমিক্যালসের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বসতে চান। আবার দিল্লি এসে মমতাও দাবি তুলতে পারেন, বিহারের জন্য কেন্দ্র যদি বিশেষ প্যাকেজের আশ্বাস দিতে পারে, তা হলে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কেন নয়! পাশাপাশি, পশ্চিম পণ্য পরিবহণ করিডর নিয়ে সরকার তৎপরতা দেখালেও পূর্ব করিডর নির্মাণে কেন্দ্র সক্রিয় নয় কেন— সে প্রশ্নও তুলতে পারেন মমতা। কেননা, মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন, পূর্ব করিডর বাস্তবায়িত হলে পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মতো মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় উন্নয়নের কাজ এগিয়ে নেওয়া সহজ হবে। রাজ্য সরকারের আরও ক্ষোভ, সীমান্ত এলাকার উন্নয়নের জন্যও কেন্দ্র সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছে না। অথচ পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের সীমান্ত রয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে জড়িত। তাই সীমান্ত এলাকার পরিকাঠামো উন্নয়ন জরুরি। কেন্দ্র কেবল অনুপ্রবেশ বন্ধ করা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, কিন্তু সে জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো বাড়ানোয় নজর দিচ্ছে না। এ ছাড়া, অন্য বিষয়ও রয়েছে। যেমন, রাজ্যের আর্সেনিক কবলিত এলাকায় পানীয় জলের সুরাহা। অন্য রাজ্যগুলিতে সিএসআই আর এ জন্য কাজ করছে। রাজ্যের দাবি, আর্সেনিক মোকাবিলায় কেন্দ্রকে সাহায্য করতে হবে।
দিল্লি সফরের সময়ে সংসদের অধিবেশন চললে মমতা এক বার অন্তত সেন্ট্রাল হলে গিয়ে জাতীয় রাজনীতির হাল হকিকত বোঝার চেষ্টা করেন। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে দিল্লি এলে এ বারও তার অন্যথা হবে না। আর সংসদ ভবনে এলে তৃণমূলের সংসদীয় দলের নতুন ঘরেও যাবেন তিনি। তবে এ বার তাঁর অগ্রাধিকারের তালিকায় অবশ্যই থাকবে স্থল সীমান্ত চুক্তির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আর্থিক টানাপড়েনের বিষয়টি।
ছিটমহলগুলিতে বিনিময়ের বিষয় সরেজমিনে দেখতে কোচবিহারের তৃণমূল সাংসদ রেণুকা সিন্হা সেখানে গিয়েছেন। এর মধ্যেই অভিযোগ উঠেছে, ও পার থেকে অনেকেই ভারতে আসতে চাইছেন। কিন্তু তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টির সত্যতা কতটা, তা স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে চাইছেন তৃণমূল সাংসদ। পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনা করবেন তিনি।