সাত রুগ্ণের এক। ডানকান গোষ্ঠীর ডিমডিমা চা বাগান। —ফাইল চিত্র।
রাজ্যে বিধানসভা ভোটের আবহে চা-বাগান নিয়ে রাজনীতির যে দড়ি টানাটানি চলছিল, তা নতুন মাত্রা পেল। উত্তরবঙ্গে ডানকান গোষ্ঠীর সাতটি রুগ্ণ চা-বাগান পরিচালনার দায়িত্ব হাতে নিতে চলেছে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রক। গত ব়ৃহস্পতিবার মন্ত্রক এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। তাতে বলা হয়েছে, কেন্দ্রের তরফে বাগানগুলি পরিচালনার ক্ষমতা তুলে দেওয়া হবে টি বোর্ডের হাতে।
যদিও টি বোর্ডের পক্ষে বাগান পরিচালনার কাজ কতটা সুষ্ঠু ভাবে চালানো সম্ভব, রাজ্য প্রশাসনের একাংশে সেই সংশয় প্রকট। এই মহলের দাবি, চা বাগান চালানোটা বোর্ডের কাজ নয়, প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞও তাদের হাতে নেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তকে ‘স্বাগত’ জানানোর পাশাপাশি দিল্লির উদ্দেশে হুঁশিয়ারির বার্তা ছুড়েছেন। ‘‘কেন্দ্র বাগানগুলোর দায়িত্ব নিচ্ছে, খুব ভাল কথা। কিন্তু শ্রমিকদের যাবতীয় বকেয়া পাওনা, রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। নজর রাখতে হবে, শ্রমিকেরা যেন অনাহারে মারা না যান।’’— শুক্রবার মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর দাবি, ‘‘মালিকের থেকে বকেয়া আদায় করে শ্রমিকদের দিতে রাজ্য কাজ শুরু করেছিল। প্রথম দফায় মালিকপক্ষ ৪০ কোটি টাকা দিতে রাজিও হয়েছিল। আশা করব, কেন্দ্র এখন সেই টাকা আদায় করে শ্রমিকদের পাইয়ে দেবে।’’ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, শ্রমিকেরা ভাল থাকলেই তিনি খুশি।
উত্তরবঙ্গে ডানকান গোষ্ঠী পরিচালিত ১৪টি চা-বাগান সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্রে একাধিক রিপোর্ট পেয়ে টি বোর্ডের ডিরেক্টর প্রতিটি বাগানে ঘুরে দিল্লিতে রিপোর্ট পেশ করেছিলেন। রাজ্যও রিপোর্ট দেয়। বিভিন্ন রিপোর্ট মোতাবেক বীরপাড়া, গেরগন্দা, লঙ্কাপাড়া, তুলসীপাড়া, হান্টাপাড়া, ধুমছিপাড়া ও ডিমডিমা— এই সাতটি বাগানের অবস্থা বেশ সঙ্গিন। তাই জনস্বার্থে ও বাগান রক্ষার তাগিদে সে গুলির পরিচালনভার টি বোর্ডকে দেওয়া হচ্ছে বলে মন্ত্রকের দাবি।
ডুয়ার্সের চা বাগানগুলোয় বিজেপির ভোটের হার ভাল। তাই চা বাগানের দুর্দশা নিয়ে বিজেপি বরাবর সরব। সম্প্রতি বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ রাজ্য নেতৃত্বকে চা-শ্রমিকদের স্বার্থে জোরদার আন্দোলন করতে বলেছেন। অন্য দিকে ডানকানের বিভিন্ন বাগান থেকে নানা অভিযোগ পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীও সক্রিয়, কারণ তাঁর কাছেও উত্তরবঙ্গের ভোট অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মালিকপক্ষকে যেমন সিআই়ডি মারফত ডেকে পাঠিয়েছেন, তেমন প্রশাসনের তরফে চাপ দিয়ে বকেয়া মেটানোর প্রতিশ্রুতি আদায় করেছেন।
এমতাবস্থায় ভোটের আগে বাগানের দায়িত্ব নিয়ে বিজেপি রাজ্যের শাসকদলকে চাপে ফেলতে চেয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক রাহুল সিংহ এ দিন বলেছেন, ‘‘চা-বাগান নিয়ে রাজ্য উদাসীন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরাই দরবার করি। তাই কেন্দ্র এগিয়ে এসে বাগান হাতে নিল। এটা বিজেপির সাফল্য।’’ বস্তুত কেন্দ্রীয় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এ মাসেই শিলিগুড়ি এসে বন্ধ বাগান নিয়ে বৈঠক করে গিয়েছেন, যেখানে রাজ্যের তরফে ছিলেন চা বিষয়ক মন্ত্রিগোষ্ঠীর সদস্য পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সেখানে স্থির হয়েছিল, রাজ্য ও টি বোর্ড বন্ধ বাগানের জন্য নতুন মালিক খুঁজবে। মমতাও মালিকপক্ষকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘যদি চালাতে না পারেন, আমরা বাগান হাতে নিয়ে নেব।’’
শ্রমিক নেতাদের একাংশের মতে, বিধানসভা ভোটের আগে বন্ধ বাগান ঘিরে কেন্দ্র-রাজ্য টক্কর দানা বেঁধেছে। দিল্লির সিদ্ধান্ত তারই অঙ্গ। চা শ্রমিক সংগঠনগুলির যৌথ কমিটির সদস্য মনিকুমার ডার্নাল বলেন, ‘‘বাগান খোলার প্রক্রিয়া চলাকালীন এ নতুন পদক্ষেপ। আশা করি, ফল ভাল হবে।’’
কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ডানকান গোষ্ঠীর কর্তা জিপি গোয়েন্কার বক্তব্য অবশ্য জানা যায়নি। এ দিন তিনি ফোন ধরেননি, এসএমএসের জবাব দেননি। গোষ্ঠী-সূত্রের দাবি: সরকারি বিজ্ঞপ্তির বাইরে তাঁদের কিছু জানা নেই। ডানকানের কোনও বাগান বন্ধও নেই।
ডানকানের ১৪টি চা-বাগানে স্বাভাবিক কাজ শুরু হওয়ার কথা ১ ফেব্রুয়ারি। গত সপ্তাহে শ্রম দফতরের কর্তাদের উপস্থিতিতে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে এ-ও ঠিক হয়েছিল, কাজ শুরুর আগে মালিকপক্ষ বকেয়া ১০০ কোটির মধ্যে ৪০ কোটি মিটিয়ে দেবে। কিন্তু তার দিন তিনেক আগে সাতটি বাগানের দায়িত্ব কেন্দ্র এ ভাবে নিয়ে নেওয়ায় কিছু মহলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সিপিএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রশ্ন, ‘‘শ্রমিকদের পাওনা এ বার কে মেটাবে? মালিক আর কেন্দ্র ও রাজ্য এক হয়ে এটা করছে।’’
সংশয় নবান্নের অন্দরেও। বাগানের জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত আইনি জটিলতা তার অন্যতম কারণ। উপরন্তু অনেকের প্রশ্ন, টি-বোর্ড কী ভাবে বাগান চালাবে! তাঁদের যুক্তি: চা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, নিলামের ব্যবস্থা, গবেষণা ও কিছু লাইসেন্স দেওয়া বা বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে বোর্ডের হাতে। তার বেশি কিছু নয়। ‘‘বরং কেন্দ্রীয় সংস্থা অ্যান্ড্রু ইউলের হাতে দু’টো বাগান আছে। তারা এলে তা-ও বাস্তবসম্মত হতো।’’— মন্তব্য নবান্নের এক কর্তার। মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাগান কেন্দ্র চালালে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে আরও সচেতন পদক্ষেপ করা ভাল।’’
সূত্রের ইঙ্গিত, টি বোর্ড কী ভাবে বাগান চালাবে, সে সম্পর্কে দিল্লিরও ধারণা নেই। আমলারাও দোটানায়। এমনকী, এর জেরে বিজ্ঞপ্তি বদলানোর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।