এত সুর এত গান, তবু সঙ্কটে গানওলা

গড়িয়াহাট বাজারের ক্যাসেটের দোকান থেকে বাবার সঙ্গে হাত ধরে বেরোচ্ছে ছোট্ট মেয়েটা। হাতের প্যাকেটে মান্না দে-র পুজোর গান। ছোটবেলার সেই সন্ধেটা স্পষ্ট মনে আছে সঙ্গীতশিল্পী জয়তী চক্রবর্তীর। ‘‘শুধু জামাকাপড় নয়, নতুন ক্যাসেটগুলোর মধ্যেও লুকিয়ে থাকত পুজোর গন্ধ।’’

Advertisement

সাম্য কার্ফা ও সূর্য্য দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:০৮
Share:

গড়িয়াহাট বাজারের ক্যাসেটের দোকান থেকে বাবার সঙ্গে হাত ধরে বেরোচ্ছে ছোট্ট মেয়েটা। হাতের প্যাকেটে মান্না দে-র পুজোর গান।

Advertisement

ছোটবেলার সেই সন্ধেটা স্পষ্ট মনে আছে সঙ্গীতশিল্পী জয়তী চক্রবর্তীর। ‘‘শুধু জামাকাপড় নয়, নতুন ক্যাসেটগুলোর মধ্যেও লুকিয়ে থাকত পুজোর গন্ধ।’’ কিন্তু কিছুদিন আগে ওই এলাকায় গিয়ে দোকানটা আর খুঁজে পাননি তিনি।

শহরের বহু সিডি-ক্যাসেটের দোকানেই তালা পড়েছে গত কয়েক বছরে। উঠে গিয়েছে মিউজিক ওয়র্ল্ড। দক্ষিণ কলকাতার নামী শপিং মলে আর একটি সিডি-ডিভিডি বিপণিও বন্ধ হয়ে জামাকাপড়ের দোকান হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, দক্ষিণ কলকাতারই আরও একটি বনেদি দোকান বন্ধের পথে। ‘ডাউনলোডিং’-এর বাজারে সিডি-ক্যাসেট যদি বাজার থেকে ক্রমশ হারিয়েই যায়, সিডি-ক্যাসেটের দোকানের মতোই মিউজিক কোম্পানিগুলোও কি ঝাঁপ ফেলবে তবে? নতুন সিডির বিক্রি যখন প্রায় তলানিতে ঠেকেছে, গানের কোম্পানির সংসার চলছে কী করে?

Advertisement

কলকাতার একটি মিউজিক কোম্পানির কর্ণধার মহুয়া লাহিড়ী জানিয়েই দিচ্ছেন, গানের ব্যবসায় এই মুহূর্তে লাভ তেমন নেই। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বলছেন, “এটা তো চাল-ডালের ব্যবসা নয়। নিজের কাজটাকে ভালবাসতে না পারলে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে আসাই উচিত নয়। শুধু বাণিজ্য নিয়ে ভাবলে তো চলবে না।”

কিন্তু একেবারে না ভাবলেও তো চলবে না। আয়টা হচ্ছে কোথা থেকে?

মিউজিক কোম্পানি ও শিল্পীদের একাংশের কথায় ইঙ্গিত, সিডি-র মরা জোয়ারে বাণিজ্যের যেটুকু মুখরক্ষা হচ্ছে, তার সিংহভাগ কৃতিত্ব কিন্তু ডিজিটালেরই। ‘বৈধ’ ডিজিটাল, যেখানে ২ টাকা থেকে ৭ টাকা ফেললে বিভিন্ন অনলাইন স্টোর থেকে বৈধ ভাবে গান ডাউনলোড করা সম্ভব। ইউটিউব-সহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও অনলাইন মিউজিক স্টোরে এখন নিজেদের রেকর্ড করা গান, এমনকী গোটা অ্যালবামটাই তুলে দেয় মিউজিক কোম্পানি। গান মেলে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনেও। সেখান থেকে শ্রোতারা যখন অনলাইন স্ট্রিমিং-এ পুরো গানটি শোনেন কিংবা ইচ্ছে হলে পয়সা দিয়ে মোবাইল বা কম্পিউটারে সেটিকে ডাউনলোড করেন, তখন তার একটা লভ্যাংশ পায় মিউজিক কোম্পানি।

মেট্রো থেকে অটো, ড্রইংরুম থেকে অফিসরুম— ইয়ারপ্লাগ গোঁজা ‘গানপ্রেমী’ বহু। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে গানটা তিনি শুনছেন, সেটা পাওয়া ব্লু-টুথ বা হোয়াটসঅ্যাপে। কিংবা কোনও সাইট থেকে মুফতে ডাউনলোড করা। ক’জন আর বৈধ ভাবে পয়সা দিয়ে ডাউনলোড করেন! একটি ঐতিহ্যশালী মিউজিক কোম্পানির শীর্ষ কর্তা সৈয়দ ফজলে করিম বললেন, “ব্যবসায় লাভক্ষতির নানা মাপকাঠি আছে। আমরা গত বছর লাভ করেছি। শেয়ারহোল্ডারদের ১৫% ডিভিডেন্ডও দিয়েছি।” তিনিই জানালেন, অনলাইনে গান-বাণিজ্যের এখন তিনটি রাস্তা— ব্রাউজার ভিত্তিক, অ্যাপ ভিত্তিক এবং মোবাইল। বৈধ ওয়েবসাইট থেকে গান ডাউনলোডের রাস্তা তো রয়েইছে। তার পাশাপাশি শাস্ত্রীয় ও ভক্তিমূলক সঙ্গীতের অ্যাপ তৈরি করেও অ্যাপল ও অ্যান্ড্রয়েড স্টোরে ছেড়েছে করিমের সংস্থা। এ ছাড়া রয়েছে গান-ভরা ‘মিউজিক কার্ড’। সোজা কথায় পেন ড্রাইভ। দোকানে বা অনলাইন স্টোরে দেখেশুনে কিনে ফেলা যেতে পারে কিশোরকুমারের ২ জিবি গান।

মহুয়াও স্বীকার করলেন, তাঁদের আয় এখন মূলত ডিজিটাল থেকেই। সেখানে মেলে বিজ্ঞাপনও। এ বার পুজোয় বাবুল সুপ্রিয়, মনোময় ভট্টাচার্য, শান-দের সিডি বের করেছে মহুয়ার সংস্থা। প্রত্যেকটি অ্যালবামই ‘অডিও জিউক বক্স’-এর আকারে আপলোড করা হয়েছে সংস্থার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে। শ্রোতারা যত বার সেই অ্যালবাম শুনবেন (অর্থাৎ যতগুলি ‘ভিউ’ হবে), সেই নিরিখে মিউজিক কোম্পানিও রয়্যালটি পাবে।

দুই মিউজিক কোম্পানির শীর্ষ পদাধিকারীই বললেন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আয়ের ভিত্তিতে রয়্যালটি বাবদ টাকা তাঁরা শিল্পীকে দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া ফিজিক্যাল সেল (এ ক্ষেত্রে সিডি) যেটুকু আছে। বাচিক শিল্পী ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন নেট দুনিয়ার দৌলতে মাঝে মাঝেই বহু পুরনো সিডির জন্য এখনও রয়্যালটি পান। গীতিকার-সুরকার-গায়ক অনুপম রায়ের মতে অবশ্য, এ দেশে এবং এ রাজ্যে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে টাকা আসার ব্যাপারটা এখনও স্বচ্ছ নয়। তাঁর মতে, “ইউটিউব শুধু নয়, যে কোনও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকেই টাকা আসার কথা। আমাদের ব্যবসার মডেলটা যদি স্বচ্ছ হয়, তা হলে টাকা আসা উচিত। কিন্তু এখানে সেটা হয় কই?” করিম মনে করছেন, নিত্যনতুন আকর্ষণীয় সম্ভার আরও বেশি করে ডিজিটাল দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যেই রয়েছে মিউজিক কোম্পানির টিকে থাকার রসদ। নিজেরা নতুন সিডি তৈরি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের গান-ভরা পেন ড্রাইভের বিক্রি বাড়ছে। মহুয়া আবার অনলাইনের পাশাপাশি সিডি নিয়েও বিভিন্ন রকম পরীক্ষামূলক কাজ চালিয়ে যেতে চান।

আশার রেখাটা এখানেই। শিল্পী থেকে মিউজিক কোম্পানির কর্ণধারেরা একটা বিষয়ে একমত— জমা-খরচের খাতা যা-ই বলুক, কাজ থামানোর প্রশ্নই ওঠে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement