তৃণমূলে কড়া নাড়ল সিবিআই

আর নেতা-মন্ত্রী নয়, সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে এ বার সরাসরি তৃণমূল দলকেই নোটিস ধরাল সিবিআই। ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে দলের যাবতীয় আয়ব্যয়ের খতিয়ান চেয়েই চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে খবর। গত ৫ মার্চ পাঠানো ওই চিঠিতে আজ, মঙ্গলবারের মধ্যে সমস্ত নথি দাখিল করতে বলা হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি বিক্রি করে কত টাকা পাওয়া গিয়েছে সেই হিসেব।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৫ ০৪:১১
Share:

আর নেতা-মন্ত্রী নয়, সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে এ বার সরাসরি তৃণমূল দলকেই নোটিস ধরাল সিবিআই। ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে দলের যাবতীয় আয়ব্যয়ের খতিয়ান চেয়েই চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে খবর। গত ৫ মার্চ পাঠানো ওই চিঠিতে আজ, মঙ্গলবারের মধ্যে সমস্ত নথি দাখিল করতে বলা হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি বিক্রি করে কত টাকা পাওয়া গিয়েছে সেই হিসেব।

Advertisement

সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, নিয়ম মেনে তৃণমূল ভবনে চিঠি পাঠানো হয়েছে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের নামে। যিনি দলের তরফে আয়কর দফতরকে প্রতি বছর হিসেব দাখিল করেছেন। কিন্তু ঘটনা হল, সিবিআই চিঠি পাঠানোর আগেই সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে মুকুলকে সরিয়ে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৪ ফেব্রুয়ারির দলীয় বৈঠকে প্রথমে মুকুলের সঙ্গেই সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক নিয়োগ করা হয় সুব্রত বক্সীকে। তার পর ২৮ তারিখ একক ভাবে ওই পদের দায়িত্ব দেওয়া হয় সুব্রতকে।

সিবিআইয়ের নোটিস নিয়ে মুকুল প্রকাশ্যে কিছু না-বললেও ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, ব্যক্তিগত ই মেল-এ চিঠির প্রতিলিপি তাঁর কাছে এসেছে। কিন্তু আসলে তা দলকেই দেওয়া হয়েছে। ফলে বর্তমান সাধারণ সম্পাদককেই ওই চিঠির জবাব দিতে হবে। এ সংক্রান্ত যাবতীয় নথিও বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের কাছেই থাকার কথা। ওই সব নথির নাগাল পাওয়ার কোনও এক্তিয়ারই তাঁর আর নেই। সে কথা সিবিআই-কে চিঠি দিয়ে জানিয়েও দিয়েছেন বলে ঘনিষ্ঠজনদের বলেছেন মুকুল। অন্য দিকে, সুব্রত এ দিন দাবি করেন, “আমি সিবিআইয়ের চিঠির ব্যাপারে কিছুই জানি না।”

Advertisement

সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার আগেই তৃণমূলের নির্বাচনের খরচ নিয়ে সর্বপ্রথম প্রশ্ন তুলেছিলেন সিপিএম নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেব। তাঁর অভিযোগ ছিল, ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে সারদার টাকা খরচ করেছে তৃণমূল। তিলজলার তৃণমূল ভবন থেকে ওই টাকার বড় অংশ বিলি করা হয়েছিল। পরবর্তী কালে মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা ছবি বিক্রি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন গৌতম। ওই ছবিগুলি কারা, কত টাকায় কিনেছেন সেই তালিকা প্রকাশ করার দাবিও তোলেন তিনি।

সিবিআই তদন্ত শুরুর পরে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন তদন্তকারীদের জানিয়েছিলেন, তিনি প্রচুর টাকা দিয়ে মমতার আঁকা ছবি কিনেছিলেন। পরবর্তী কালে গ্রেফতার হওয়া সাসপেন্ডেড তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষও একই দাবি করেন। গত বছরের লোকসভা ভোটে বিরোধীদের প্রচারের একটা বড় হাতিয়ার হয়েছিল মমতার ছবি। রাজ্যে এসে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন খোদ নরেন্দ্র মোদী।

দিল্লি যাওয়ার সময় মুকুল রায়। সোমবার। —নিজস্ব চিত্র।

তৃণমূলকে পাঠানো চিঠিতে মমতার ছবি বিক্রি করে কত টাকা দলের তহবিলে ঢুকেছে, তা জানতে চেয়েছে সিবিআই। সংস্থার গোয়েন্দারা বলছেন, শুধু মমতার ছবি বিক্রির সূত্রে নয়, অন্য পথেও যে সারদার কোটি কোটি টাকা তৃণমূলের তহবিলে ঢুকেছে সেই প্রমাণ তাঁরা পেয়েছেন এই মামলায় গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্ত এবং সারদার হিসেবরক্ষক, কর্মী ও গাড়ির চালকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে।

পাশাপাশি, আয়কর দফতরকে তৃণমূলের দায়ের করা আয়ব্যয়ের হিসেব খতিয়ে দেখেও বিস্তর অসঙ্গতি চোখে পড়েছে বলে সিবিআই তদন্তকারীদের দাবি। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, ‘ত্রিনেত্র’ নামে একটি সংস্থার কাছ থেকে তৃণমূল পেয়েছে মোট ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। যদিও খাতায়কলমে সংস্থাটির রোজগার মাত্র ৩৩ হাজার টাকা! এমনকী, সংস্থার যে ঠিকানা খাতাপত্রে দেওয়া আছে, সেখানে গিয়ে কারও খোঁজ মেলেনি। গোয়েন্দাদের একাংশের ধারণা, সারদার কাছ থেকে পাওয়া নগদ টাকা ‘ত্রিনেত্র’র মতো সংস্থার নাম করে দলের তহবিলে ঢোকানো হয়েছে। তাদের হিসেব খতিয়ে দেখলে সুপ্রিম কোর্ট সারদা কেলেঙ্কারির পিছনে যে ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্র’ খুঁজতে বলেছে, তার হদিস পাওয়া যেতে পারে।

সিবিআই সূত্রে বলা হচ্ছে, তৃণমূলের কাছ থেকে সরকারি ভাবে হিসেবপত্র পাওয়ার পরে ফের তা খতিয়ে দেখা হবে। আয়কর দফতরের সহায়তা নিয়ে সংগ্রহ করা হবে আরও বিস্তারিত তথ্য। যাঁরা অনুদান বাবদ প্রচুর টাকা দলের তহবিলে দিয়েছেন, তাঁদের আয়ব্যয়ও যাচাই করে দেখা হবে। তার পর প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তৃণমূলের পদাধিকারীদের। সিবিআইয়ের এক কর্তার কথায়, “এই সব হিসাবপত্রে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে মুকুল রায়ের সই রয়েছে। তাই প্রয়োজনে এ ব্যাপারে তাঁকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।” সিবিআই গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, মুকুল ইতিমধ্যেই তদম্তের কাজে অনেক সহায়তা করেছেন। তাই এ ব্যাপারেও তাঁর সাহায্য পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

হিসাবপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া যে দলকে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলতে পারে, তা বুঝতে পারছেন তৃণমূল নেতারা। তাই বিষয়টি নিয়ে তাঁরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। কিন্তু আজ, মঙ্গলবারই তো সিবিআই-কে নথি পাঠানোর শেষ দিন? তৃণমূল সূত্র বলছে, মমতা এখন দিল্লিতে। তাঁর অনুপস্থিতিতে হিসাবপত্র সিবিআই দফতরে পাঠানো হবে কি না, তা নিয়ে দলে মতবিরোধ রয়েছে।

বিরোধীরা অবশ্য এই খবরকে হাতিয়ার করে তৃণমূলকে বিঁধতে শুরু করে দিয়েছে। সিপিএম নেতা গৌতম দেব এ দিন বলেন, “নির্বাচনের সময়েই আমি তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ করেছিলাম। সঠিক তদন্ত হলে গোটা দলটিই জেলে যাবে।” সারদা কেলেঙ্কারির সিবিআই তদন্ত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের বক্তব্য, “এই সব জানতে পেরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আতঙ্কিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন।” বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেছেন, “তৃণমূলের দলীয় হিসাব জালিয়াতিতে ভরা। সারা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছবি কত দামে বিক্রি হয়েছিল তা জানার জন্য অধীর আগ্রহে বসে রয়েছেন।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement