—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
কোনও এক ব্যক্তির তাৎক্ষণিক প্রবৃত্তি? নাকি বড় কিছু ধামাচাপা দেওয়ার সম্মিলিত ষড়যন্ত্র? আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক-পড়ুয়াকে খুন এবং ধর্ষণের ঘটনার ‘মোটিভ’ বা উদ্দেশ্য কী ছিল?
ঘটনা সামনে আসার পর থেকে ১৫ দিন পেরিয়ে গেলেও এই মূল প্রশ্নেরই স্পষ্ট উত্তর মিলছে না বলে অভিযোগ উঠছে নানা মহল থেকে। কলকাতা পুলিশের পরে এখন সিবিআই তদন্ত চালালেও এ ব্যাপারে কোনও পক্ষই স্পষ্ট উত্তর দিতে পারছে না। আন্দোলনকারী চিকিৎসকেদের প্রশ্ন, আর কত দিন দাবি-পাল্টা দাবি চলবে? এখনও তো প্রকৃত কারণ কী সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। তরুণীর পরিবারেরও আক্ষেপ, ‘‘মেয়েটাকে কেন মারা হল, সেটাই তো ১৫ দিনে জানতে পারলাম না।’’
গত ৯ অগস্ট ঘটনা সামনে আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কলকাতা পুলিশ গ্রেফতার করে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে। এখনও পর্যন্ত এই ঘটনার সে-ই এক মাত্র ধৃত। পেশায় কলকাতা পুলিশের ওই সিভিক ভলান্টিয়ারের সম্পর্কে নানা তথ্য এর পরে সামনে আসতে শুরু হয়। প্রাথমিক তদন্তের পরে কলকাতা পুলিশই জানায়, ওই সিভিক অত্যন্ত বদমেজাজি, একাধিক সম্পর্কে লিপ্ত এবং যাঁকে-তাঁকে, যখন-তখন যৌন হেনস্থাকারী এক চরিত্র। পুলিশ সূত্রে এ-ও দাবি করা হয়, ধৃতের মোবাইল ফোনে এমন সব পর্নোগ্রাফি পাওয়া গিয়েছে, যা এ দেশে নিষিদ্ধ। তাকে বুঝতে সেগুলিই যথেষ্ট— এমন দাবিও করা হয়। কিন্তু সেই সময়েই প্রশ্ন ওঠে, ফোনে পর্ন-ভিডিয়ো রয়েছে, তা দিয়ে কি কাউকে বিচার করে ফেলা যায়? এ-ও প্রশ্ন ওঠে, যদি ধৃতের এমনই হয়ে থাকে, তা হলে তাকে হাসপাতালে যখন-তখন, যেখানে-সেখানে ঘোরার অনুমতি কী ভাবে দেওয়া হল? লালবাজারের এক কর্তাকে দাবি করতে শোনা যায়, ‘‘আমাদের কাছে কেউ কখনও কোনও অভিযোগ করেননি।’’
কিন্তু তখনও মূল প্রশ্ন, ধৃত যদি একাই এই খুন এবং ধর্ষণ করে থাকে, তা হলে এমনটা সে করল কেন? অর্থাৎ ‘মোটিভ’ কী? এ বিষয়ে কলকাতা পুলিশের তৈরি বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট-এর এক কর্তা দাবি করেছিলেন, ‘‘পুরোটাই বিকৃত কামের ফল। যৌন ক্ষুধা মেটাতে হাসপাতালে ঢুকে এমনটা করে ফেলেছে সে।’’ কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, হাসপাতালের যেখানে ঘটনাস্থল, ওই ভিতরের অংশে অবলীলায় পৌঁছে গিয়ে সে কী করে এমনটা ঘটিয়ে বেরিয়ে চলে এল? কারও নজরে পড়ল না? কেউ বাধা দিলেন না? এই প্রেক্ষিতে কলকাতা পুলিশ একটি ঘটনাপ্রবাহ প্রকাশ করে। তাতে দাবি করা হয়, ঘটনার আগে দফায় দফায় মদ্যপান করেছে ওই সিভিক। কলকাতার একাধিক যৌনপল্লিতে ঘুরেছে সে। এই সময় এক পুলিশ কর্তা এ-ও মন্তব্য করেন, ‘‘সারা দিন যে এই সব করে বেড়িয়েছে, সে কেমন তা হলে ভাবুন!’’
কিন্তু এই তথ্য প্রকাশ হতেই অনেকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, আকণ্ঠ মদ্যপান করে কেউ একা এই কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারে? আন্দোলনকারী চিকিৎসকেদের প্রশ্ন, ‘‘দফায় দফায় মদ খেলে, এতগুলো যৌনপল্লিতে ঘুরলে তো ক্লান্ত হয়ে পড়ার কথা। সেই ক্লান্তি নিয়ে কেউ কী করে এমনটা ঘটাবে?’’ এর পরেই কলকাতা পুলিশের তরফে দাবি কিছুটা পাল্টে যায়। বলা শুরু হয়, ধৃত যৌনপল্লিতে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেখানে তাকে কোনও যৌনকর্মী ঘরে ঢুকতে দেননি। তাঁর উপর তাঁদের নাকি এতটাই রাগ, যে ঝামেলা করে তাকে তাড়িয়ে দেন তাঁরা। এর পর এক তরুণীকে ভিডিয়ো কল করেও প্রত্যাখ্যাত হতে হয় তাকে। কলকাতা পুলিশ সূত্রে দাবি, সেই রাগ নিয়েই ঘুরছিল ওই সিভিক। যার বহিঃপ্রকাশ হয়েছে চিকিৎসক তরুণীর উপরে। যদিও আইনজীবীদের প্রশ্ন, ‘‘তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় করে ফেলেছে— এ কথা বলা আসলে এই অপরাধকে অনেকটাই লঘু করে দেখানোর চেষ্টার শামিল। পরে যখন বোঝা যাচ্ছে, সেই চেষ্টা খুব একটা কাজে আসছে না, বরং জনমানসে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে, তখন পুরনো শত্রুতা রয়েছে কি না, তদন্ত করে দেখার কথা বলা হয়।’’
আন্দোলনকারী চিকিৎসকেদের মতে, মৃতদেহ যে ভাবে উদ্ধার হয়েছে, তাতে ধাক্কা খাচ্ছে হঠাৎ রাগে ঘটিয়ে ফেলার ‘মোটিভ’। কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক সংস্থায় কাজ করা এক আধিকারিক বলেন, ‘‘হঠাৎ রাগে কেউ এমন ঘটনা ঘটালে মৃতার একটা হাত কি কপালের উপরে রেখে দিয়ে যাবে? যাতে দূর থেকে দেখলে মনে হয়, মৃত নয়, ঘুমোচ্ছেন! সে কি মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা কাগজে কিছু লিখে আবার কালো কালি দিয়ে কেটে দিয়ে যাবে? সে কি মৃতার ডায়েরির পাতা ছিঁড়ে রেখে যাবে? প্রশ্ন ছত্রেছত্রে। যা অন্য কোনও গুরুতর ‘মোটিভ’-এর দিকেই ইঙ্গিত করে।’’
কী সেই ‘মোটিভ’? হাসপাতালের আর্থিক দুর্নীতির মামলা হাতে নিয়ে সেই ‘মোটিভ’-এরই গভীরে পৌঁছতে চাইছে সিবিআই।