সিবিআই দফতরে মনোরঞ্জনা সিংহ। রবিবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী
এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট, সল্টলেক পুলিশের সামনে হাজিরা দিয়েছিলেন আগেই। এ বার সিবিআইয়ের জেরার মুখোমুখি হলেন মনোরঞ্জনা সিংহ। সেই সূত্রেই সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনেরও মুখোমুখি হতে হল তাঁকে।
সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে উধাও হওয়ার আগে সিবিআইকে লেখা চিঠিতে সুদীপ্ত দাবি করেছিলেন, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাতঙ্গ সিংহের প্রাক্তন স্ত্রী মনোরঞ্জনার সঙ্গে একটি বৈদ্যুতিন চ্যানেল তৈরি ও একটি সংস্থা বিক্রি করা নিয়ে প্রায় ৪২ কোটি টাকার চুক্তি হয়েছিল তাঁর। তার মধ্যে ২৫ কোটি টাকা মনোরঞ্জনাকে দিয়েছিলেন সুদীপ্ত। মাতঙ্গ সিংহের মালিকানাধীন একটি টিভি চ্যানেল সুদীপ্তকে জোর করে বিক্রি করা নিয়েও মনোরঞ্জনার দিকে আঙুল তুলেছিলেন সুদীপ্ত। তাঁর দাবি, ওই চ্যানেলটি কেনার জন্য তিনি মাতঙ্গকে ২৮ কোটি টাকা দিয়েছিলেন। এ সব নিয়েই রবিবার মনোরঞ্জনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্তকারীরা। সুদীপ্ত এবং মনোরঞ্জনার বক্তব্য যাচাই করতে তাঁদের মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এ দিন। মাতঙ্গ সিংহকেও তলব করা হয়েছে বলেও সিবিআই সূত্রের খবর।
সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তের রায় দেওয়ার সময় বৃহত্তর ষড়যন্ত্র এবং সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জড়িত থাকার কথা বলেছিল সুপ্রিম কোর্ট। গত কয়েক দিনে সিবিআই তদন্তের গতিপ্রকৃতি সে দিকেই ইঙ্গিত করছে। সিবিআই সূত্রের খবর, চলতি সপ্তাহে শাসক দলের দুই মন্ত্রী এবং তিন সাংসদ-সহ কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হতে পারে। এই ব্যক্তিদের কারও নাম মিলেছে সিবিআইকে লেখা সুদীপ্তর চিঠিতে। কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ইডি। কয়েক জনের নাম সারদার নথিপত্রে মিলেছে বলে সিবিআই সূত্রের খবর। তদন্তকারীরা বলছেন, এঁদের সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য প্রয়োজনে কুণাল ঘোষকেও নিজেদের হেফাজতে নিতে পারে সিবিআই।
আলিপুর আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সন্ধির অগ্রবালকে। নিজস্ব চিত্র
সুদীপ্ত সেন সিবিআইকে লেখা চিঠিতে জানিয়েছিলেন, মাতঙ্গ ও মনোরঞ্জনা তাঁর কাছ থেকে বিপুল টাকা নিয়েছিলেন। সুদীপ্তর দাবি, উত্তর-পূর্ব ভারতে একটি বৈদ্যুতিন চ্যানেল খোলা এবং একটি সংস্থা বিক্রি করা নিয়ে মনোরঞ্জনার সঙ্গে তাঁর ৪২ কোটি টাকার চুক্তি হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী তিনি মনোরঞ্জনাকে ২৫ কোটি এবং তাঁর বাবা এন কে গুপ্তকে ৩ কোটি টাকা দিয়েছিলেন। এই চুক্তির সময় প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের স্ত্রী নলিনী চিদম্বরমের কথাও উল্লেখ করেছেন সুদীপ্ত। বলেছেন, চুক্তি রূপায়ণে আইনি পরামর্শদাতা হিসেবে নলিনী ১ কোটি টাকা নিয়েছেন। সুদীপ্তর অভিযোগ, তাঁর আর্থিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা না করেই নলিনী এই চুক্তি রূপায়ণের জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিলেন।
এ দিন বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ সল্টলেকে সিবিআই দফতরে ঢোকেন মনোরঞ্জনা। প্রায় আট ঘণ্টা ধরে দফায় দফায় জেরার পরে রাত আটটা নাগাদ তিনি বাইরে আসেন। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, মনোরঞ্জনা এ দিন তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, ৪ জন সাক্ষীর সামনে আইন মেনেই সুদীপ্তর সঙ্গে চুক্তিপত্র সই হয়েছিল। এই সংক্রান্ত নথিপত্র তিনি আগেই ইডি ও বিধাননগর পুলিশকে দিয়েছিলেন। গত মে মাসে ইডি ও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন মনোরঞ্জনা। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, সুদীপ্ত তাঁকে ২১ কোটি টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা খরচের প্রতিলিপিও শ্যামল সেন কমিশনে দেখিয়েছিলেন তিনি।
মনোরঞ্জনার দাবি, মাতঙ্গ সিংহের যে চ্যানেল সুদীপ্তকে বিক্রি করা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তা ঠিক নয়। সম্প্রতি আনন্দবাজারকে তিনি বলেন, তিনি এনই টিভি ও এনই বাংলার প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণের বিষয়টি সামলেছিলেন। পরে তাঁর সঙ্গে মাতঙ্গ সিংহের বিবাদ শুরু হয়। মাতঙ্গ তাঁকে সংস্থা থেকে বার করে দেন। সেই সংক্রান্ত মামলা এখনও কোম্পানি ল’ বোর্ডে চলছে। মনোরঞ্জনার বক্তব্য, “আমি ল’ বোর্ডকে জানিয়েছি, এনই টিভিতে থাকা আমার শেয়ার এর পর সুদীপ্ত সেনকে ২৮ কোটি টাকায় বেচে দেন মাতঙ্গ।”
বস্তুত, দিন কয়েক আগেই গুয়াহাটিতে এনই টিভি এবং ফ্রন্টিয়ার টিভির অফিসে হানা দিয়েছিল সিবিআই। দু’টি অফিস সিল করেও দিয়েছিলেন গোয়েন্দারা। সাক্ষাৎকারে মনোরঞ্জনা বলেছিলেন, “সুদীপ্তর ২৮ কোটি টাকা দিয়ে মাতঙ্গ যা যা কিনেছেন, তা এনই টিভি-র নতুন অফিসে রাখা। পুরনো অফিসে কী-ই বা পড়ে আছে?” নতুন দফতরে থাকা তথ্য ও জিনিসপত্র কেন বাজেয়াপ্ত করা হয়নি, সে প্রশ্নও তুলেছিলেন তিনি। সিবিআই সূত্রে বলা হচ্ছে, উত্তর-পূর্ব ভারতে আরও অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন সুদীপ্ত। সেই বিনিয়োগের সূত্র ধরেই অসমের এক প্রাক্তন মন্ত্রী, এক বিধায়কের নাম উঠে এসেছে। সেগুলিও খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।
ইতিমধ্যেই সারদা কেলেঙ্কারিতে রাজ্যে দু’জনকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। বুধবার গ্রেফতার করা হয় ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতুকে। শনিবার রাতে শহরের ব্যবসায়ী সজ্জন অগ্রবালের পুত্র সন্ধিরকে গ্রেফতার করা হয়। এ দিন তাঁকে আলিপুর আদালতে হাজির করানো হলে ২৭ অগস্ট পর্যন্ত সিবিআই হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, সুদীপ্তর হয়ে সেবির সঙ্গে মধ্যস্থতা করতেন সন্ধির। এই বিষয়টি এ দিন আলিপুর আদালতেও জানিয়েছে সিবিআই। যদিও সন্ধিরের আইনজীবী চন্দ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায় এ দিন আদালতে সওয়াল করেন, সন্ধিরের জড়িত থাকার কোনও প্রমাণ সিবিআই হাজির করতে পারেনি।
সিবিআই অবশ্য এ দাবি মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, উপযুক্ত প্রমাণ মেলাতেই সন্ধিরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেবি, কোম্পানি নিবন্ধক ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতো নিয়ামক সংস্থাগুলির সঙ্গে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা আর কোন কোন ব্যক্তি পালন করতেন, সে সম্পর্কেও সূত্র পেয়েছেন বলে দাবি গোয়েন্দাদের।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, সিবিআইকে লেখা চিঠিতে সজ্জন অগ্রবালের ছেলের নামে অভিযোগ করেছিলেন সুদীপ্ত সেন। চিঠিতে সুদীপ্ত জানিয়েছেন, সজ্জন অগ্রবাল, তাঁর ছেলে এবং নিতু গত তিন বছরে প্রায় ৪০ কোটি টাকা নিয়েছেন তাঁর কাছ থেকে। এই টাকা রতন ও রবীন নামে দুই গাড়িচালকের মাধ্যমে পাঠানো হতো বলে সুদীপ্ত সিবিআইকে দেওয়া চিঠিতে জানিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে সুদীপ্ত ওই চিঠিতে সজ্জনের এক মুম্বইবাসী আত্মীয়ের কথাও লিখেছেন। লিখেছেন ঘোষ পদবিধারী এক ব্যক্তির কথাও।
চিঠিতে সুদীপ্ত লিখেছেন, এক্সাইড মোড়ের কাছে সজ্জন অগ্রবালের অফিসে তিনি গিয়েছিলেন। চা ব্যবসায়ী সজ্জন এবং তাঁর ছেলে দিল্লির কয়েক জন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। সজ্জন তাঁকে জানিয়েছিলেন, সেবি শীর্ষ কর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করতে সাধারণত প্রতি মাসে ২০ লক্ষ টাকা করে নিয়ে থাকেন তিনি। নিতু ও সজ্জনের এই টাকা নেওয়ার প্রচুর প্রমাণও রয়েছে বলে সুদীপ্ত দাবি করেছেন।
শনিবারই রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজতকে প্রায় আট ঘণ্টা ধরে জেরা করেছিল সিবিআই। আমেরিকার লাস ভেগাসে প্রবাসী বাঙালিদের একটি অনুষ্ঠান এবং একটি বাংলা সিনেমার প্রিমিয়ারে সারদার টাকা ঢালা নিয়ে রজত মজুমদারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা। তদন্তকারীরা জানান, এ রাজ্য থেকে লাস ভেগাসে যাওয়ার টিকিট, ভিসা-সহ নানা ব্যবস্থার তদারকির দায়িত্ব ছিল সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের। কিন্তু সারদা নিজেরা না করে অন্য কয়েকটি সংস্থাকে দিয়ে সে কাজ করিয়েছিল। এ দিন তেমনই একটি সংস্থার কর্ণধারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিবিআই। তদন্তকারীরা বলছেন, লাস ভেগাসে কী খাতে কত খরচ হয়েছিল, সে তথ্য জানতেই এই জিজ্ঞাসাবাদ।