অনুব্রত মণ্ডল। ছবি: সংগৃহীত।
বাড়ির পরিচারক বিদ্যুৎবরণ গায়েনের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। অথচ তাঁর ‘নমিনি’ বাড়ির মালিক অনুব্রত মণ্ডলের (কেষ্ট) মেয়ে সুকন্যা! মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতনের কর্মী বিদ্যুতের নামে কেনা হয়েছে ৭ কোটি ৭১ লক্ষ টাকার জমি। অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে আনাজবিক্রেতা ও ধোপা বিজয় রজকের নামে। যাঁর মাঝেমধ্যেই ডাক পড়ত কেষ্টর গা-হাত-পা মালিশের জন্য। এই অ্যাকাউন্টেও লেনদেনের অঙ্ক চোখ কপালে তোলার মতো।
একই ভাবে, বোলপুরের বিভিন্ন তৃণমূল নেতা-কর্মীদের নামে বেনামি অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন অনুব্রত। সেখানেও জমা পড়ত গরু পাচারের ঘুষের টাকা। নিজের মালিকানাধীন সংস্থার নামের সঙ্গে সঙ্গে সেই টাকায় ভোলে বোম চালকল, শিব শম্ভু চালকল, কালীমাতা ট্রেডার্স, মা দুর্গা ট্রেডার্সের মতো সংস্থার পাশাপাশি বেনামে আরও বিভিন্ন সম্পত্তি কিনেছিলেন বীরভূমের এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা। কালো টাকা সাদা করতে ১০-১২ বার লটারি জেতার ‘চিত্রনাট্য’ সাজিয়েছিলেন অনুব্রত ও সুকন্যা। সুপ্রিম কোর্টে পেশ করা ইডি-র চার্জশিটে দাবি, এ ভাবেই গরু পাচারের ঘুষ হিসেবে মেলা টাকায় বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন অনুব্রত। ফুলেফেঁপে উঠেছে তাঁর পরিবার, এমনকি সাঙ্গোপাঙ্গরা।
গরু পাচারের তদন্তে দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টে দায়ের করা ওই চার্জশিটে ইডি জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে থাকা টাকা এবং নামে-বেনামের সম্পত্তি মিলিয়ে শুধু অনুব্রতেরই ৪৮ কোটি ৬ লক্ষ টাকারও বেশি সম্পদের হদিস মিলেছে। যার পুরোটাই গরু পাচারের ঘুষের টাকায় গড়ে ওঠা। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি এনামুল হকের গরু পাচার মসৃণ ভাবে চালানোর ব্যবস্থা করে দিতেন। তার বিনিময়েই কোটি-কোটি টাকা জমা পড়ত অনুব্রতের সিন্দুকে।
কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটির দাবি, এই ৪৮.০৬ কোটির পাশাপাশি গত ডিসেম্বর পর্যন্ত গরু পাচার থেকে আসা আরও ২৯ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার সম্পত্তির সন্ধান পেয়েছে তারা। যা রয়েছে অন্যদের নামে। অর্থাৎ, এখনও পর্যন্ত গরু পাচারের টাকায় তৈরি ৭৭ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকার সম্পত্তির খোঁজ পেয়েছে ইডি।
তাদের চার্জশিট অনুযায়ী, অনুব্রতের ৪৮ কোটি ৬ লক্ষ টাকার সম্পত্তির মধ্যে তাঁর, সুকন্যার ও বিভিন্ন সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রায় ১২ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা নগদে জমা ছিল। অনুব্রত, সুকন্যাদের মালিকানাধীন সংস্থা ভোলে বোম চালকল, শিব শম্ভু চালকল, এএনএএম অ্যাগ্রোটেক, নীড় ডেভেলপার, কালীমাতা ট্রেডার্স, মা দুর্গা ট্রেডার্সের নামে ২০.৭৭ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। এই সংস্থাগুলির মুনাফার খাতায় আছে আরও ৫ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। অনুব্রতের বেনামি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেও ৫ কোটি ৯৪ লক্ষ টাকা রয়েছে।
গরু পাচারের ঘুষের কালো টাকা সাদা করতে লটারি জেতার অভিনব পন্থা নিয়েছিলেন অনুব্রত-সুকন্যা। ইডি-র জেরার মুখে অনুব্রত জানিয়েছিলেন, ২০১৮ থেকে তিনি ও সুকন্যা ১০-১২ বার লটারি জিতেছেন। শান্তিনিকেতনের বাপি গঙ্গোপাধ্যায়ের গাঙ্গুলি লটারি থেকে আসল লটারি জেতা ব্যক্তিদের কাছ থেকে অনুব্রতের সাঙ্গপাঙ্গরা নগদ টাকায় ওই টিকিট কিনে নিতেন। লটারির জেতা অর্থ চলে আসত অনুব্রত-সুকন্যার অ্যাকাউন্টে। এ ভাবেই অনুব্রতের অ্যাকাউন্টে তিন দফায় ২ কোটি টাকা ঢুকেছিল। সুকন্যা তাঁর দু’বছরের আয়কর রিটার্নে লটারিতে ১ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা জেতার কথা জানিয়েছিলেন। গরু পাচারের কালো টাকা সাদা করতে অনুব্রত তাঁর হিসাবরক্ষক মণীশ কোঠারিকে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা দিতেন। মণীশকে নগদে মোট ২৮ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল।
ইডি-র হাতে গ্রেফতারির পরে সুকন্যা এখন তিহাড় জেলে। শনিবার জেলেই অনুব্রত-সুকন্যার প্রথম বার দেখা হওয়ার কথা। সুকন্যা ইডি-র প্রশ্নের মুখে দাবি করেছিলেন, তিনি অনুব্রতের টাকা, সম্পত্তি, ব্যবসার বিষয়ে কিছুই জানতেন না। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার ফর্ম, চেকবইয়ের মতো যেখানে তাঁকে সই করতে বলা হত, তিনি তা করে দিতেন। কিন্তু মণীশ জানিয়েছিলেন, সুকন্যাই তাঁকে যাবতীয় নির্দেশ দিতেন। ইডি-র দাবি, অনুব্রত তাঁদের দেওয়া বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তিনি ও তাঁর মেয়ে মণীশ কোঠারির দেখানো পথে সমস্ত ব্যবসা তৈরি করেছিলেন।
নিজের পরিবারের লোকেদের পাশাপাশি বোলপুরের তৃণমূল নেতা বিশ্বজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়, ওমর শেখ, দলের কর্মী তাপস মণ্ডল, শ্যামাপদ কর্মকার, প্রাথমিক শিক্ষক অর্ক দত্ত, পরিচারক বিদ্যুৎবরণ গায়েন, আনাজ বিক্রেতা ও ধোপা বিজয় রজক (যাঁকে অনুব্রতের গা-হাত-পা মালিশের জন্যও ডাকা হত) প্রমুখের নামেও অ্যাকাউন্ট খুলিয়েছিলেন অনুব্রত। এ সব অ্যাকাউন্টে গরু পাচারের লক্ষ লক্ষ টাকা জমা হত। পরে তা কেষ্টর কাজে লাগত। সুকন্যার সঙ্গে এএনএম অ্যাগ্রোটেকের ডিরেক্টর হিসেবেও বিদ্যুতের নাম ছিল বলে ইডি-র দাবি।
চার্জশিট অনুযায়ী, এঁরা সকলেই সমাজের নিচুতলা থেকে উঠে আসা, কম আয়সম্পন্ন মানুষ। কেউ অনুব্রতের বাড়িতে, কেউ বোলপুরের তৃণমূল অফিসে, কেউ বোলপুর পুরসভার ঠিকাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। অনুব্রত বেনামে টাকা রাখতে তাঁদের কাজে লাগিয়েছিলেন। এ ছাড়া, অনুব্রতের ছোটবেলার বন্ধু সুব্রত বিশ্বাসের একটি সংস্থার নামে খোলা ব্যাঙ্কের কারেন্ট অ্যাকাউন্টেও গরু পাচারের নগদ টাকা জমা পড়ত। অনুব্রতের দেহরক্ষী সেহগল হোসেন এ সব সামলাতেন। টাকার প্রয়োজন হলেই তাঁর মোবাইল কাজে লাগিয়ে গরু পাচারের মূল চাঁই এনামুল হককে ফোন করতেন অনুব্রত।