সিপিমের রাজ্য সম্মেলনের প্রথম দিন
স্বাধীনতার পরে বাংলায় বামেদের এত দুরবস্থা কখনও হয়নি। এই স্বীকারোক্তি করেই সংগঠনের খোলনলচে বদলের ডাক উঠে এল সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনে।
কলকাতার প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে সিপিএমের ২৬তম রাজ্য সম্মেলন। দলের বর্ষীয়ান নেতা বিমান বসু সম্মেলন শুরুর আগে পতাকা উত্তোলন করেছেন। সম্মেলনে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ করতে গিয়ে দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, স্বাধীনতার পরে কখনও এমন কঠিন অবস্থায় এ রাজ্যের কমিউনিস্ট পার্টিকে পড়তে হয়নি। বিজেপি আর তৃণমূলের মতো দু’টি ‘চরম প্রতিক্রিয়াশীল’ দলের বিরুদ্ধে একই সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। জনসমর্থনও ব্যাপক ভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিধানসভায় কোনও প্রতিনিধি নেই, এমন অবস্থা অতীতে হয়নি কখনও। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার লক্ষ্যে উপযুক্ত আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সংগঠনকে গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন সূর্যবাবু। দলীয় সূত্রের খবর, উদ্বোধনী পর্বে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি মনে করিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যে দলের সাংগঠনিক প্লেনামের পরে প্রায় ৬ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এখনও প্লেনামের সব সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যায়নি। কমিটিতে বা পদে অনেকেই আছেন, যাঁরা সক্রিয় ভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। তাঁর মতে, বাংলায় সংগঠনের খোলনলচে নতুন করে সাজানো দরকার।
সিপিএমের ২৫তম রাজ্য সম্মেলন হয়েছিল ২০১৮ সালে। মাঝের চার বছরে নির্বাচনে বেনজির বিপর্যয় হয়েছে, জনসমর্থনও বিপুল ভাবে কমেছে। এই নিয়ে প্রশ্নের জবাবে এ দিন সম্মেলনের অবসরে সূর্যবাবু বলেছেন, ‘‘জনসমর্থন কমেছে, তথ্যেই দেখা যাচ্ছে। কেমন এমন হয়েছে, কী ভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যাবে, সে সব নিয়ে সম্মেলনেই বিশদে আলোচনা হবে।’’ সম্মেলন চলবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত।
রাজ্যে সংগঠনের হাল যে উদ্বেগজনক, দলকে ভোগাচ্ছে ‘নিষ্ক্রিয়তা’র সমস্যা— তথ্য দিয়ে সেই ছবি তুলে ধরা হয়েছে সম্মেলনের রিপোর্টেও। পেশ হওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৮ সালে বাংলায় দলের সদস্য-সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৮৪ হাজার ৭৪০। সর্বশেষ ২০২১ সালের পুনর্নবীকরণের পরে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ৬০ হাজার ৮২০। অর্থাৎ দুই সম্মেলনের মাঝে সদস্যে কমেছে প্রায় ২৪ হাজার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘বিগত চার বছরে রাজ্যে পার্টিj সদস্য-সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে প্রায় ২৪ হাজার। প্রকৃত খারিজের সংখ্যা এর থেকে যথেষ্ট বেশি। নতুন অন্তর্ভুক্তির পরেও হ্রাসের পরিমাণ ২৪ হাজার। উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় সদস্যপদ খারিজ হওয়ার পরেও নিষ্ক্রিয়তার পরিমাণ কম নয়। নির্বাচনী পর্যালোচনায় জেলা কমিটিগুলির রিপোর্টে নির্বাচনী সংগ্রামে ৩০ থেকে ৪০% সদস্যের নিষ্ক্রিয়তার উল্লেখ করা হয়েছে। মিছিল-সমাবেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পার্টি সদস্যের উপস্থিতি থাকছে না’। একই সঙ্গে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘উচ্চতর কমিটিগুলি কি তাদের দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে’?
প্রথম দিনে সব জেলারই এক জন করে প্রতিনিধি সম্মেলনে বক্তৃতা করেছেন। ছাত্র-যুব সংগঠন রাস্তায় নেমে ভাল কাজ করছে কিন্তু দলের নেতাদের সে ভাবে আন্দোলনের সামনের সারিতে দেখা যাচ্ছে না, এই সমালোচনা কোচবিহার, দক্ষিণ দিনাজপুর, উত্তর ২৪ পরগনা-সহ কিছু জেলার প্রতিনিধিদের বক্তব্যে উঠে এসেছে বলে দলীয় সূত্রের খবর। জোট-বিরোধিতার সুর ছিল বর্ধমান, কলকাতা জেলার। জোট সমর্থন করেছেন বেশ কিছু প্রতিনিধিই। দলীয় সূত্রের খবর, বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরে জোট এবং পলিটবুরোর দু-এক জন নেতার প্রকাশ্যে সমালোচনার জন্য সম্মেলনের মঞ্চে ‘দুঃখপ্রকাশ’ করেছেন প্রাক্তন বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য। প্রকাশ্যে মুখ খোলার জন্য রাজ্য কমিটি তাঁকে তিন মাসের জন্য মুখ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল, জেলা সম্পাদক ভর্ৎসনা করেছিলেন, তা-ও উল্লেখ করেছেন তিনি। তবে সাংগঠনিক ত্রুটি নিয়ে তিনি সম্মেলনেও সরব হয়েছেন। প্রথম দিনে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতায় এবং মহিলাদের অধিকার রক্ষার দাবি ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বহুত্ববাদের পক্ষে তিনটি প্রস্তাব পাশ হয়েছে