প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানম। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
স্বাধীনতা দিবসের দিন জাতীয় পতাকার অবমাননা করা হয়েছে এই অভিযোগে কলকাতা হাই কোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। সেই মামলায় রাজ্যকে ভর্ৎসনা করল হাই কোর্ট। প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম বললেন, ‘‘মামলাকারীর রাজনৈতিক পরিচয়ের জন্যই কি এ ব্যাপারে রাজ্যের অনীহা?’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কোর্টে মামলা হওয়ার আগে তো রাজ্যেরই এ বিষয়ে অতি সক্রিয় হয়ে পদক্ষেপ করা উচিত ছিল! তাই নয় কি?’’
স্বাধীনতা দিবসের দিন জাতীয় পতাকার অবমাননা সংক্রান্ত একটি ঘটনা নিয়ে মামলা করেছিলেন রাজ্যের বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু। মঙ্গলবার মামলাটির শুনানি ছিল প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানম এবং হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চে। সেখানেই রাজ্যকে লক্ষ্য করে একের পর এক কড়া মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি।
মঙ্গলবার শুভেন্দুর আইনজীবী শ্রীজীব চক্রবর্তী এবং আইনজীবী সূর্যনীল দাস আদালতে ঘটনাটির বর্ণনা দিয়ে এই ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের আর্জি জানান, মামলাকারীর কথা শুনেই রাজ্যের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘আপনাদের কি মনে হয় না, এই অভিযোগ গুরুত্বপূর্ণ? এটা জাতীয় পতাকার অবমাননার অভিযোগ। রাজ্যের এ বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন হওয়া উচিত ছিল। এ নিয়ে অনীহা দেখাবেন না।’’ তবে এখানেই থেমে না গিয়ে এর পর কিছুটা কটাক্ষের সুরেই রাজ্যের আইনজীবীর উদ্দেশে বিচারপতি বলেন, ‘‘মামলাকারীর (শুভেন্দু অধিকারী) জন্যই কি এই অনীহা? আদালতে কে এসেছে সেটা ভুলে যান। জাতীয় পতাকার অপমান মানে আমাদের সবার অপমান। সব কিছুতেই রাজনৈতিক রং দেখবেন না। পুলিশ এবং প্রশাসনের উচিত ছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে পদক্ষেপ করা।’’
রাজ্যের তরফে মঙ্গলবার আদালতে ছিলেনন অ্যাডভোকেট জেনারেল। প্রধান বিচারপতি তাঁকে লক্ষ্য করেই মন্তব্য করেন। কিন্তু ভর্ৎসনা করেন রাজ্যকে। জাতীয় পতাকার অবমাননার ঘটনায় রাজ্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে পারেনি তা বুঝিয়ে দিয়েই প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘যে দিন থেকে এ রাজ্যে এসেছি, দেখেছি যে, মামলাকারীর পরিচয় বেশি গুরুত্ব পায় রাজ্যের কাছে। তা হলে কি এই জাতীয় পতাকার অবমাননার মামলাটিও আমাদের ছেড়ে দেওয়াই উচিত?’’ প্রশ্ন তোলেন প্রধান বিচারপতি।
গত মে মাসে কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি পদে শপথ নেন বিচারপতি শিবজ্ঞানম। তবে তার আগে প্রায় দেড় বছর ধরে তিনি কলকাতা হাই কোর্টে থেকেছেন। ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে কলকাতা হাই কোর্টে রয়েছেন। বিধানসভা ভোট পরবর্তী বাংলাকে কাছ থেকে দেখেছেন। মঙ্গলবার সেই অভিজ্ঞতার কথা টেনে এনেই রাজ্যকে মামলাকারীর পরিচয় নিয়ে কটাক্ষ করেছেন প্রধান বিচারপতি। বলেছেন, ‘‘মনে রাখবেন, আপনি চোখ বন্ধরাখলেই পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায় না।’’
এর জবাবে অবশ্য রাজ্যের আইনজীবী বলেছিলেন, ‘‘আমরা গ্রেফতার করেছি। পদক্ষেপও করেছি। ৩১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ প্রধান বিচারপতি যদিও সে জবাবে সন্তুষ্ট হননি। বরং বলেছেন, ‘‘গ্রেফতার করলেই সব কিছু হয় না। জেলে তিন বেলা খাওয়ার পর আবার জামিন পেয়ে ঘুরে বেড়াবে। তার চেয়ে এঁদের কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের কোনও জেলে পাঠিয়ে দিন।’’ রাজ্যের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘জাতীয় পতাকার অপমান যদি শিশুদের সামনে হয়, তবে সেটা দুর্ভাগ্যজনক। তাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। জাতীয় সঙ্গীত এ রাজ্যের কবির লেখা। আর সেখানে এমন ঘটনা ঘটলে এ রাজ্যে ভাবমূর্তি কোথায় পৌঁছবে?’’
এর পরে বিচারপতি নির্দেশ দেন, ঘটনাটির বিষয়ে আদালতের কাছে হলফনামা জমা দিতে হবে স্বরাষ্ট্রসচিবকে। এ ছাড়া, ঘটনাটি নিয়ে রিপোর্টও দিতে হবে পুলিশকে। কারা গ্রেফতার হয়েছেন? তাঁদের বাড়ি কোথায়? তাঁদের পরিবারে কে কে রয়েছেন, তাঁরা কী করেন, সেই বিষয়ে তথ্য দিতে হবে আদালতকে। এমনকি, কোন জেলে রাখা হয়েছে, তা-ও জানাতে হবে। ৬ সেপ্টেম্বর এই মামলার পরবর্তী শুনানি।