সুন্দরবনের প্রত্যন্তে কেক-রুটির কারখানা খুলল মেয়েরা

ক্রিসমাস আসার আগেই কেক এসে যাচ্ছে প্রত্যন্ত সুন্দরবনে। তবে দাড়ি-টুপিওয়ালা সান্তা ক্লজ নয়, গ্রাম-মফস্সলের মানুষের কাছে তাজা কেক-রুটির উপহার নিয়ে হাজির এলাকার গরিবগুর্বো মেয়েরা। নানা দোকান, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে তাঁরা তা দিচ্ছেন বিনা পয়সায়।

Advertisement

অমিত কর মহাপাত্র

রায়দিঘি শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৬:৩৪
Share:

নন্দকুমারপুরে কারখানার কাজের তদারকিতে সমিতির সদস্যরা।

ক্রিসমাস আসার আগেই কেক এসে যাচ্ছে প্রত্যন্ত সুন্দরবনে। তবে দাড়ি-টুপিওয়ালা সান্তা ক্লজ নয়, গ্রাম-মফস্সলের মানুষের কাছে তাজা কেক-রুটির উপহার নিয়ে হাজির এলাকার গরিবগুর্বো মেয়েরা। নানা দোকান, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে তাঁরা তা দিচ্ছেন বিনা পয়সায়।

Advertisement

এ অবশ্য ব্যবসার সূচনা। পরিশ্রম, সঞ্চয় আর সাহসে ভর করে পাঁচ ডেসিমেল জমিতে ১১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে রুটি, কেক ও বিস্কুট তৈরির কারখানা তৈরি করল সুন্দরবনের নন্দকুমারপুরের সুন্দরবন মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী সমবায় সমিতি। রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, কারখানার উদ্বোধন করলেন জার্মানির কনস্যুলেট জেনারেল ওলাফ ইভারসেন।

এখন কর্মীদের প্রশিক্ষণ চলছে। এই পর্বে প্রতি দিন হাজারখানেক রুটি, কেক ও বিস্কুট নানা প্রতিষ্ঠানে বিক্রি ও বিলি করা হচ্ছে নমুনা হিসাবে। যাতে তাঁরা এর গুণমান সম্পর্কে নিঃসংশয় হ’ন। ১ জানুয়ারি থেকে পুরোদমে উৎপাদন শুরু হবে। অনেক দোকানদার বুকিং সেরে ফেলতে চাইছেন। মধূসূদন চকের দোকানদার চিত্তরঞ্জন দাস, রণজিৎ প্রামাণিক, সুচিত্রা বেরা, সকলেই কেক ও বিস্কুটের প্রশংসা করে বলেন, “মান যথেষ্ট ভাল। একেবারে টাটকা পাচ্ছি। বিকোবে ভালো।”

Advertisement

রীতিমতো বাজার সমীক্ষা করেই এই কাজে নামছেন মেয়েরা। সমিতির সম্পাদক সোমা দাস জানান, এই এলাকায় কেক-বিস্কুট আসে সেই ডায়মন্ড হারবার বা জয়নগর থেকে। ৪০ কিলোমিটার পেরিয়ে আসতে সময় লাগে, সকালের জিনিস রাতে বা পরের দিন বিক্রি হয়। তাই এলাকায় তৈরি জিনিসের চাহিদা থাকবে। সেই সঙ্গে সমবায় সমিতির সহযোগী ‘সবুজ সংঘ’ নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বেশ কিছু স্কুল, হস্টেল, কলেজ রয়েছে। সেখানে তৈরি বাজার আছে। তা ছাড়া সমিতির সঙ্গে যুক্ত মেয়েদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর উপসঙ্ঘগুলিকেও ডিলারশিপ দেওয়া হবে, স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য।

সমিতির তরফে জানানো হয়েছে, কারখানায় প্রতি দিন দু’হাজার রুটি ও এক হাজার কেক উৎপাদনের প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। প্রতি দিন সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার রুটি ও কেক তৈরি হলে দৈনিক মুনাফা হবে প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকা।

জার্মানির একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘হ্যানস্কেটিক ইন্ডিয়া ফোরাম’-এর সভাপতি অমল মুখোপাধ্যায় বলেন, “ওই মহিলাদের সহযোগী সংস্থা সবুজ সংঘের হাসপাতালে এর আগে আমরা সৌরবিদ্যুৎ-চালিত রেফ্রিজারেটার দিয়েছি। সেই সময়ে দেখেছিলাম, এই মহিলাদের জীবনসংগ্রাম ও তাদের শিশুদের অপুষ্টি। তাই আমরা এইটুকু সাহায্যের হাত ওঁদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছি।” ওই সংস্থার তরফে মেয়েদের কেক-বিস্কুট তৈরির প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে।

জার্মানির ওই সংস্থা স্বয়ংক্রিয় মেশিন-সহ কারখানা গড়তে ১১ লক্ষ টাকা দিলেও সামগ্রী উৎপাদনের কাঁচামাল, বিদ্যুৎ, কর্মীদের পারিশ্রমিক ইত্যাদি দেবে সমিতি। উৎপাদনের প্রাথমিক খরচ হিসাবে ৪৫টি গোষ্ঠীর সদস্যদের থেকে চাঁদা হিসাবে ৯০ হাজার টাকা মিলেছে।

সমিতির সভানেত্রী দেবীরানী জানা বলেন, “আমাদের সঞ্চিত অর্থ নেই, তাই গোষ্ঠীর সকলেই ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য নানা ভাবে ত্যাগ স্বীকার করছেন।” তিনি জানান, সমিতির সদস্য রাধারানি দাসের থেকে বার্ষিক পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে কারখানার জমির লিজ চুক্তি হয়েছে। তবে রাধারানি দেবী জানিয়ে দিয়েছেন, সমিতির লাভ না হওয়া পর্যন্ত তিনি লিজের টাকা নেবেন না। সমিতির পাঁচ জন কর্মী তাঁদের মাসিক বেতন আপাতত ছ’মাস নেবেন না। কারখানায় উৎপাদন ও প্যাকেজিং-এর দায়িত্বে থাকা ১৫ জন কর্মী নেবেন না পারিশ্রমিক।

বছর দুয়েক আগেও সুন্দরবনের এই মেয়েরা একসঙ্গে ১ লক্ষ টাকা চোখে দেখেননি। মুরগি পালন, ধান থেকে চাল তৈরির মতো ছোটখাট ব্যবসা করতেন তাঁরা। মথুরাপুর ২ ও পাথরপ্রতিমা ব্লকের মেয়েরা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সবুজ সংঘের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গত বছর নভেম্বরে তৈরি করে সমবায় সমিতি। ৩০টি গোষ্ঠীর ৩২২জন মহিলা মাত্র ১ লক্ষ টাকার মূলধন নিয়ে সমিতির কাজ শুরু করে। সমিতির কোষাধ্যক্ষা কাকলি দাস জানান, এক বছরেই আরও ১৫টি গোষ্ঠী যুক্ত হয়ে সদস্য সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫০৩। বর্তমানে মোট মূলধন সাড়ে চার লক্ষ টাকা। ওই টাকা থেকে সমবায় সমিতি তার সদস্য গোষ্ঠীগুলিকে ঋণ দিয়েছে ৩ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা। আরও ১ লক্ষ টাকা লগ্নি করা হয়েছে সমিতির নিজস্ব ব্যবসা, স্যানিটারি মার্টে।

কিন্তু কেক-রুটির কারখানা এই মেয়েদের স্বপ্নের প্রকল্প। কল্পনা ভুঁইয়া, উমা মণ্ডল, নীলিমা দাসেরা বলেন, “নদীতে, খেতে আমাদের উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়। বাচ্চাদের পুষ্টির ঘাটতি হত। এ বার অন্তত আমরা নিশ্চিন্ত হব, তাদের মুখে আমাদের হাতেই তৈরি টাটকা খাবার তুলে দিতে পারছি।”

কেক-বিস্কুটের নমুনায় খুশি হলেও, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কিছুটা সংশয়ও রয়েছে, মহিলারা কতটা পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন। নন্দকুমারপুরের ব্যবসায়ী অজিত সামন্ত বলেন, “কেকের স্বাদ ও গুণগত মান ভাল। ভবিষ্যতে যেন এর পরিবর্তন না হয়।” মহবতনগরের বুদ্ধদেব ভুঁইয়া, প্রদীপ বেরা অবশ্য টাটকা জিনিস মেলায় খুশি। তাঁরা বলেন, “বাজারের রুটির তুলনায় এর স্বাদ ভাল। বলতে গেলে, হাতে গরম পাচ্ছি। দূর থেকে আসা রুটি বাসি মনে করে অনেকে খান না। এ বার সে সমস্যা হবে না।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement