আমলাদের জেদে আধাসেনায় সায় মমতার

সরাসরি ‘না’ বলে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ আমলারা হাল ছাড়েননি। পুরভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা নিয়ে চাপ দিয়েই গিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁদের মত মেনে নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুরভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনে রাজি হয়েছেন তিনি।

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৪
Share:

সরাসরি ‘না’ বলে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ আমলারা হাল ছাড়েননি। পুরভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা নিয়ে চাপ দিয়েই গিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁদের মত মেনে নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুরভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনে রাজি হয়েছেন তিনি।

Advertisement

বিষয়টি নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়েছে প্রশাসনিক মহলে।

স্বরাষ্ট্র দফতরের এক সূত্র জানাচ্ছেন, মার্চ মাসের মাঝামাঝি রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় নবান্নে চিঠি লিখে পুরভোটে ১৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানোর কথা বলেন। সরকার যাতে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কথা বলে সিআরপিএফ মোতায়েনের ব্যবস্থা করে, সেই অনুরোধও জানান নির্বাচন কমিশনার। শুধু তাই নয়, এ মাসের ২১ তারিখ রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গে দেখা করেন সুশান্তবাবু। কেন্দ্রীয় বাহিনী নামিয়ে পুরভোট করার কথা রাজ্যপালকেও জানান তিনি। এ ব্যাপারে রাজভবন থেকে যাতে নবান্নের সঙ্গে কথা বলা হয়, সেই অনুরোধ জানান নির্বাচন কমিশনার। কেশরীনাথ তার পরেই রাজ্যের শীর্ষ আমলাদের জানিয়ে দেন, পুরভোট শান্তিপূর্ণ করতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজন আছে বলে তিনিও মনে করছেন।

Advertisement

এমতাবস্থায় প্রশাসনের শীর্ষ আমলারা বিষয়টি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন। নবান্ন সূত্রের খবর, মমতা কিন্তু কোনও অবস্থাতেই কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পুরভোটে রাজি ছিলেন না। তাঁর যুক্তি ছিল, ৯২টি পুরসভার যে কয়েক হাজার বুথে নির্বাচন হবে, সেখানে পর্যাপ্ত রাজ্য পুলিশ দেওয়া সম্ভব। তা হলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর কী প্রয়োজন? মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি ছিল, ১৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীর জন্য মোটা টাকা খরচ হবে। রাজ্যের তা আর্থিক হাল, তাতে সেই টাকা এখন জোগাড় করা সম্ভব নয়। ফলে রাজ্য পুলিশ দিয়েই ভোট করানো হবে বলে নির্বাচন কমিশনকে লিখে দিতে আমলাদের নির্দেশ দেন।

কিন্তু অবস্থান বদলাননি আমলারা। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের নেতৃত্বে তাঁরা মমতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বনগাঁ, কৃষ্ণগঞ্জের ভোটেও কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল। সেখানে শাসক দলের অনুকূলেই ফলাফল হয়েছে। বরং কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করার পর যদি শাসক দল জেতে, সেটাই সরকারের ভাবমূর্তির পক্ষে ভাল হবে। সূত্রের খবর, আমলাদের এই যুক্তি মানতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর একটাই প্রশ্ন ছিল, রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল। এখানে কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজন কোথায়?

এর আগের পুরভোটে ২০১০ সালেও কিন্তু ৭১ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল। গত পঞ্চায়েত ভোটে তৎকালীন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডের সঙ্গে রাজ্য সরকারের বিরোধেও অন্যতম বিষয় ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী। সে বার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রাজ্য কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে বাধ্য হয়েছিল। রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা তাই এ বার কোনও ঝুঁকি না নিয়ে প্রথম থেকেই কলকাতায় ৫০ কোম্পানি এবং অন্য পুরসভাগুলির জন্য আরও ১০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানোর পক্ষে সওয়াল করে গিয়েছেন।

রাজ্য নির্বাচন কমিশনারও নবান্নে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, পুরভোটে সব মিলিয়ে সাড়ে ১৩ হাজার বুথে ভোটগ্রহণ হবে। রাজ্য পুলিশ ও কলকাতা পুলিশ জানিয়েছে, প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে তারা দু’জন করে সশস্ত্র পুলিশ রাখতে পারবে। যে সব কেন্দ্রে ৩টি বুথ, সেখানে ২ জন সশস্ত্র পুলিশ এবং যে সব ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে চারটির বেশি বুথ, সেখানে এক জন অফিসার-সহ চার জন সশস্ত্র পুলিশ দেওয়া যাবে। আর নির্বাচন কমিশনারের যুক্তি ছিল, সাড়ে ১৩ হাজার বুথের মধ্যে অন্তত চার হাজার বুথ স্পর্শকাতর হিসাবে বাছা হয়েছে। এই সব বুথে বাড়তি নজরদারি প্রয়োজন।

আমলাদের পরামর্শ মুখ্যমন্ত্রী মানতে চাননি ঠিকই। কিন্তু মৌখিক আলোচনার পরে, তাঁর আপত্তির কথা জানার পরেও শীর্ষ কর্তারা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যে ফাইল পেশ করেন, তাতে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার অনুমোদনই চাওয়া হয়। অফিসাররা যে তাঁর সঙ্গে কোনও ভাবেই সহমত নন, সেই বার্তা তখনই পেয়ে যান মমতা। এক আমলার কথায়, ‘‘ফাইলেও কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়ার কথা স্পষ্ট ভাবে বলার পর মুখ্যমন্ত্রী আর আপত্তি করেননি। সম্ভবত সুপ্রিম কোর্টের হলফনামা দাখিলের তিক্ততা এ দফায় তিনি এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন।’’

মুখ্যমন্ত্রী নিজে অবশ্য এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানানো হয়েছে, বিরোধী দলগুলি কমিশনের কাছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি জানিয়েছিল। কমিশনারও সরকারকে চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু প্রতি কোম্পানি বাহিনীর জন্য রোজ দু’লক্ষ টাকা খরচ হয়। অনটনের কোষাগারে তাই রাজ্য পুলিশ দিয়েই ভোট করানোর পক্ষপাতী ছিলেন মমতা। কিন্তু কমিশনার ও বিরোধী দলগুলির মুখ চেয়েই কেন্দ্রীয় বাহিনী আনার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন তিনি।

নবান্নের অন্দরে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী এবং আমলাদের মধ্যে স্নায়ুর লড়াই নিয়ে ব্যাপক চর্চা চলছে। এর আগে সারদা মামলায় সিবিআইয়ের উপর আদালতের নজরদারি চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিল রাজ্য সরকার। সেই মামলার হলফনামার রাজনৈতিক কথাবার্তা লেখা রয়েছে বলে অভিযোগ তুলে তাতে অনুমোদন দিতে রাজি হননি মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র এবং স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের আপত্তির সরকারি হলফনামা থেকে ‘রাজনৈতিক’ কথাবার্তা বাদ দেওয়া হয়। তার পরই স্বরাষ্ট্র দফতরের এক যুগ্মসচিব সেই হলফনামায় সই করেন। গত লোকসভা নির্বাচনের সময় পক্ষপাতের অভিযোগ পেয়ে নির্বাচন কমিশন রাজ্যের পাঁচ পুলিশ সুপার এবং এক জেলাশাসককে বদলি করার নির্দেশ দিয়েছিল। সে বারও মমতা গোঁ ধরেছিলেন, কোনও বদলি তিনি মানবেন না। তখন মুখ্যসচিবই তাঁকে দৃঢ় ভাবে জানিয়েছিলেন, কমিশনের সিদ্ধান্ত মানতে প্রশাসন বাধ্য।

পুরভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়েও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আমলারা এ বারও মুখ্যমন্ত্রীর মতামত মানতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীই আমলাদের কথা মানলেন। পুরভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানোর সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিলেন। সেই অনুমোদন পাওয়া মাত্রই ২৬ মার্চ নির্বাচন কমিশনকে স্বরাষ্ট্রসচিব জানিয়ে দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে সরকারের নীতিগত আপত্তি নেই। কেন্দ্রের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলাও শুরু করেছে নবান্ন।

ভোটবিধির ফেরে গডকড়ী

আগামী ১৫ এপ্রিল হলদিয়ায় একটি ‘গ্রিন ডক’-এর উদ্বোধন করার কথা ছিল জাহাজমন্ত্রী নিতিন গডকড়ীর। রাজ্যের পুরভোটে বিধিনিষেধের দরুন ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবেন না। পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক তাঁর কী করণীয়, জানতে চেয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মঙ্গলবার কমিশন জানিয়েছে, পুর নিবার্চনী বিধি বলবৎ থাকায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ওই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করতে পারবেন না। নিবার্চনী বিধিনিষেধের ফেরে বিধাননগরে পুলিশের অনুষ্ঠান বাতিল করতে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এ দিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ রাজ্যে এলেও একই কারণে সরকারি আধিকারিকেরা তাঁর সফরে সঙ্গী হতে পারেননি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement