Buddhadeb Bhattacharjee Death

সঙ্গী ‘সদিচ্ছা’, পথ হারিয়ে বিদায় সংস্কারের পথিকের

সংস্কার ও শিল্পের পথে এগোতে চেয়ে বুদ্ধদেব কি কাজটা শেষ করতে পারেননি? নাকি বাধা দিয়ে তাঁকে এগোতে দেওয়া হয়নি? বাম জমানা অতীত হয়ে যাওয়ার অনেক পরেও এই প্রশ্নে বিতর্ক আছে, সম্ভবত থেকে যাবে।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৪ ০৮:৩০
Share:

রতন টাটার সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। —ফাইল ছবি।

‘‘কাকে কাজ করতে বলব! চেয়ার-টেবিলকে?’’ এক বার প্রশ্ন ছিল জ্যোতি বসুর। তাঁর উত্তরসূরি এসে ডাক দিয়েছিলেন ‘ডু ইট নাউ’!

Advertisement

শুরু থেকেই সংস্কারের পথে পথিক ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। হাত গুটিয়ে বসে না-থেকে শিল্প, উদ্যোগ ও কর্মসংস্কৃতির ক্ষেত্রে থমকে যাওয়া বঙ্গে সবাই মিলে নতুন উদ্যমে চেষ্টা করে দেখার মন্ত্র নিয়ে মহাকরণে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল। নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকার বদলে রাজ্যের প্রয়োজন এবং বাস্তবতা বুঝে শিল্পায়নের লক্ষ্যে এগোতে চেয়েছিলেন প্রাণপণে। যে যাত্রা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পরে পথ হারিয়েছিল। শিল্পের গন্তব্যে আর পৌঁছনো হয়নি বুদ্ধদেবের, এ রাজ্যেরও। তাঁর সদিচ্ছা, প্রয়াস এবং সে সব বাস্তবায়নের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রেখেই বিদায় নিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। এক জন আপাদমস্তক ‘ভদ্র’ রাজনীতিক।

প্রশাসনিক মহলের কেউ কেউ এখনও বলে থাকেন, ‘‘রাজ্যের স্বার্থে উন্নয়ন, শিল্পায়ন করে বাংলায় দ্বিতীয় বিধান চন্দ্র রায় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল বুদ্ধবাবুর। শুরু করেছিলেন ভাল ভাবে। চেষ্টায় আন্তরিকতা ছিল। কিন্তু শেষটা ভাল হয়নি। সংস্কার এবং শিল্পায়ন প্রয়োজন, এটা উনি বুঝেছিলেন। সদিচ্ছার সঙ্গে কাজে নেমেছিলেন। কিন্তু বিরোধী রাজনীতির (পড়তে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের) ধাক্কা সামলাতে পারেননি!’’ কঠোর বাস্তবের নিরিখে দেখলে, পরাজিত হয়ে বুদ্ধদেব যেখানে শেষ করেছিলেন, এক যুগ পরে বাংলা সেখান থেকে আর বিশেষ এগোতে পারেনি।

Advertisement

সংস্কার ও শিল্পের পথে এগোতে চেয়ে বুদ্ধদেব কি কাজটা শেষ করতে পারেননি? নাকি বাধা দিয়ে তাঁকে এগোতে দেওয়া হয়নি? বাম জমানা অতীত হয়ে যাওয়ার অনেক পরেও এই প্রশ্নে বিতর্ক আছে, সম্ভবত থেকে যাবে। সিপিএমের প্রবীণ নেতা বিমান বসুর মতো অনেকেই মনে করেন, শিল্পায়ন ছিল দলের ঘোষিত পরিকল্পনা। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বুদ্ধদেব সেই রাস্তায় এগিয়েছিলেন। কিন্তু প্রবল বিরোধিতা এবং ‘চক্রান্ত’ তাঁদের গতি রোধ করে দাঁড়িয়েছিল। প্রশাসনিক কিছু শিথিলতা ছিল। তবে তার চেয়েও প্রবল ছিল বাইরের বাধা। আবার সিপিএমেরই একাংশের মত, দল বুদ্ধদেবকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ছাড়পত্র দিয়েছিল। কিন্তু দল এবং গণ-সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে যে কৌশলে এগোলে বাধা পেরোতে সুবিধা হত, তাতে বেশ কিছু খামতি থেকে গিয়েছিল। প্রশাসনের উপরে নির্ভরশীলতা বেড়ে গিয়েছিল বুদ্ধদেবের ওই সময়ে। পরিস্থিতির ফায়দা নিয়েছিল বিরোধীরা। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব এখনও বলেন, ব্যক্তি বুদ্ধদেব ‘ভাল মানুষ’ হতেই পারেন। কিন্তু তাঁর সরকার জোর করে জমি নিতে চেয়েছিল, সেই উদ্যোগের বিরুদ্ধে মমতার নেতৃত্বে প্রতিবাদ হয়েছিল।

প্রশ্ন থাকছে, জমি না-নিয়ে শিল্পায়নের অন্য কোনও রাস্তা আছে কি? বুদ্ধ-জমানায় এই নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। বিরোধীরা অনেক সময়েই দাবি তুলেছে, বন্ধ কল-কারখানার জমিতে কেন শিল্প হবে না? বুদ্ধদেব এবং তাঁর আমলের শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন যুক্তি দিয়েছেন, বন্ধ কারখানার বেশির ভাগই এমন মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে, সেই আইনি জট কাটিয়ে নতুন কিছু চালু করা সময়সাপেক্ষ ও কঠিন। নতুন শিল্প-উদ্যোগের জন্য জমি লাগবেই। আর ভূমি সংস্কারের বাংলায় ছোট ছোট পরিমাণে জমির মালিকানা যে হেতু নানা হাতে ছড়িয়ে, তাই সরকারি অধিগ্রহণ ছাড়া পথ নেই। সেই জমি নেওয়ার ক্ষেত্রেই ‘আতঙ্ক’ ছড়িয়ে বাধা দেওয়া হয়েছে, তাই বুদ্ধদেবের সংস্কার ও শিল্পায়নও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। আবার এখানেও ভিন্ন মত হল, যে পদ্ধতিতে এগোলে এই বাধার পাহাড় ডিঙোনো যেত, অনিল বিশ্বাসের প্রয়াণের পরে সেই রাজনৈতিক ও কৌশলগত ‘নমনীয়তা’ সিপিএম এবং বুদ্ধদেবের সরকার দেখাতে পারেনি।

বিতর্ক থেকে যাবে। সরকারের কাণ্ডারী হিসেবে বুদ্ধদেবের ‘সদিচ্ছা’ উল্লেখের দাবি রাখবে। সেই সঙ্গেই ঘুরতে থাকবে ‘প্রাক্তন’ হয়ে যাওয়ার পরে তাঁর তোলা প্রশ্নটা— ‘‘শিল্প হলে কি আমার ব্যক্তিগত কোনও লাভ হত? নাকি আমাদের পার্টির ছেলেরা শুধু চাকরি করতে যেত? বাংলার ছেলে-মেয়েদের কাজের জন্য বিপুল সংখ্যায় বাইরে যেতে হবে না, এটা অন্তত নিশ্চিত করা যেত। হল না, গন্ডগোল করে দেওয়া হল! এক দিন দেখবেন, এই শহরে বয়স্ক বাবা-মায়েদের রেখে ছেলে-মেয়েদের ভাল কাজের জন্য দল বেঁধে সেই বেঙ্গালুরু, পুণে, গুড়গাঁও যেতে হবে!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement