ডিসেম্বর বনাম জানুয়ারির ব্রিগেড। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
সেই রবিবার আর এই রবিবারে অমিল অনেক।
গীতাপাঠের রবিবার সকাল সকাল ব্রিগেড শুরু হয়ে দুপুর দুপুর শেষ হয়। গোটা কর্মসূচিই ছিল সকালের মতো স্নিগ্ধ। স্তোত্রপাঠের সঙ্গে ধূপধুনোর গন্ধে ছিল পুজো-পুজো আবহ। ঢাক, কাঁসর, শঙ্খ, উলুধ্বনি শুনেছিল ব্রিগেডের ঘাস, ভিক্টোরিয়ার পরী। আর এই রবিবারের বাম যুব সংগঠনের ব্রিগেডে দুপুরের ঝাঁজ। দুপুরে শুরু হওয়া সমাবেশে নেত্রী মিনাক্ষীর কণ্ঠস্বরের মতোই গনগনে রাজনীতি। কোথায় সুরে সুরে গাওয়া গীতার শ্লোক আর কোথায় উচ্চকিত ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি! সেই রবিবার শান্তিমন্ত্র পড়ে সভা শেষ হয়েছিল আর এই রবিবার সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করে।
সেই রবিবার আর এই রবিবারে মিলও অনেক।
বড় মিল আনুগত্যে। তবে ফারাকটা ভক্তি আর ভরসার। তবে ধর্মীয় ভক্তির মতোই যে ক্ষমতার অলিন্দ থেকে অনেক দূরে থাকা রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি ভরসা ভিড় তৈরি করতে পারে সেটা দেখিয়ে দিয়েছে দুই বছরের দুই রবিবারই। দু’দিনেই অনেক ‘সপরিবার’ যোগদান বড় মিল তো বটেই। আবার ওই রবির অনুষ্ঠান আর এই রবির সমাবেশের শুরুতে মিললেন বাংলার দুই কবি কাজি নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গেরুয়াপন্থীরা বেছেছিলেন নজরুলের ‘হে পার্থসারথি বাজও শঙ্খ’ আর বামপন্থীরা গণসঙ্গীত ছেড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ গাইলেন।
দুই সমাবেশের মাঝে বছর বদলে গিয়েছে। কিন্তু আসলে ২৪ ডিসেম্বর আর ৭ জানুয়ারির মধ্যে দূরত্ব এক পক্ষকালের। দুই ব্রিগেড সমাবেশের সঙ্গে তুলনা টানায় কারও কারও কপাল কোঁচকাতেই পারে। তাঁরা হয় তো বলবেন, ওটা ছিল ধর্মীয়, এটা রাজনৈতিক। কিন্তু দু’দিনই ব্রিগেডের মাঠে উপস্থিতরা জানেন, সবটাই আসলে রাজনীতি। সবটাই লোকসভা নির্বাচনের আগে সমর্থন ঝালিয়ে নেওয়া। সেই রবিবারে মঞ্চের উপরটা গেরুয়াধারীদের দখলে থাকলেও সামনেটা ভরিয়ে রেখেছিলেন গেরুয়াপন্থী রাজনীতির রাজ্য নেতারা। সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারী, দিলীপ ঘোষেরা মুখে যাই বলুন, জমায়েত দেখিয়ে হিন্দুত্বের শক্তি দেখাতে চেয়েছিলেন তাঁরা। আবার এই রবিবারে ডিওয়াইএফআই-এর সমাবেশ বলা হলেও, মঞ্চাসীন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিম কিংবা নীচে সামনের সারিতে বসা বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুরা তো শাসক তৃণমূল কিংবা অন্য বিরোধীদের বাম-শক্তিই দেখাতে চেয়েছেন।
ব্রিগেডে ময়দানে চায়ে পে চর্চা। — নিজস্ব চিত্র।
দিনের শেষে জানুয়ারির ব্রিগেড এটা জোর গলাতেই বলতে পারে যে, নতুন প্রজন্মকে টানার বিচারে বামেরা অনেক অনেক এগিয়ে থাকল। গীতাপাঠের ভক্তকূলে কমবয়সিরাও ছিলেন, কিন্তু এত সংখ্যায় নয়। রবিবার দলীয় শৃঙ্খলা মেনে মাঠ ভরানোর বড় দায়িত্বটাই যুবরা পালন করেছেন। সামনে থেকে মনে হয়েছে এ সমাবেশ নতুন সিপিএমের। তবে কি পুরনো কর্মীরা আসেননি? এসেছেন। তবে তাঁদের একটা বড় অংশ যেন অনেকটা পিকনিকের মুডে রইলেন। অনেকেই বাড়ি থেকে খাবার দাবার নিয়ে এসেছিলেন। মঞ্চের দিকে পিছন ফিরে সবান্ধবে চর্ব, চোষ্য উপভোগ করলেন। কেউ মেঘলা রোদ গায়ে মেখে শুয়ে রইলেন। কেউ কেউ দল বেঁধে ফ্লাস্ক ভরা চা মাঝে রেখে আড্ডায় মশগুল।
সপরিবারে ব্রিগেড উৎসব। — নিজস্ব চিত্র।
আকারে ছোট হলেও ডিসেম্বরের রবিবার শৃঙ্খলা ছিল অনেকটাই বেশি। ‘দাঁড়িয়ে গীতাপাঠ করতে নেই’ বলে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পরেই মঞ্চমুখী হয়ে গীতা হাতে বসে পড়েছিলেন সকলে। শুরু থেকে শেষ একই ছিল অবস্থান। কিন্তু ক্ষমতায় থাকার সময়ে যাঁরা সিপিএম করেছেন, ব্রিগেডে আসা সেই বয়সের ‘কমরেডরা’ অনেকেই এলেন, রইলেন কিন্তু শুনলেন না কিছুই। কেউ কেউ কিছুক্ষণ থেকে, ‘সেলফি’ তুলে চলে গেলেন। ফেসবুকে দিতে হবে তো! তাঁদের অবশ্য বয়সের বিচারে মাপা যাবে না। এই ব্যাপারে নবীন আর প্রবীণে তেমন ভেদ নেই।
মঞ্চে তখন বক্তৃতা চলছে। — নিজস্ব চিত্র।
এই রবিবার সামনের দিকে কড়া বামপন্থী অনুশাসন দেখা গেলেও মাঝমাঠের পর থেকেই ঢিলে হয়ে গিয়েছিল ভিড়টা। যুব সিপিএম জমায়েতের সঠিক সংখ্যাও বলতে পারবে না। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মাঠে যেমন লোক ঢুকতেই থেকেছে, তেমন বেরিয়েও গেছেন দলে দলে। এই ব্যাপারে অবশ্যই এগিয়ে থাকবে ডিসেম্বরের ব্রিগেড। সে দিন পোশাকেও অনুশাসন দেখিয়েছিলেন গীতা-ভক্তরা। সাদা পোশাকের জমায়েতে মিশেছিল শুধু গেরুয়া। আর জানুয়ারির ব্রিগেডে গ্রাম্য মহিলার আটপৌরে শাড়ির সঙ্গেই মিশল শহুরে তরুণীর ব্র্যান্ডেড পোশাক, সানগ্লাস। মিলন হল লুঙ্গি, ধুতি, টর্ন জিনসের।
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি তৈরি হচ্ছে? — নিজস্ব চিত্র।
ব্রিগেড ময়দান অনেক সমাবেশই দেখেছে। জওহরলাল নেহরু থেকে নরেন্দ্র মোদী, অনেক প্রধানমন্ত্রীই এসেছেন কলকাতার এই দিগন্ত ছোঁয়া মাঠে। সভা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তবে ‘ব্রিগেড চলো’ বামদের স্লোগান হিসাবেই পরিচিত। আর ব্রিগেডে বরবারই সমাবেশের ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে বামেরা। কিন্তু তার ছায়া যে সব সময় ভোট রাজনীতিতে পরে না তার প্রমাণ সিপিএমের হাতেই রয়েছে। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগেই বাম-কংগ্রেস-আব্বাস জোট বড় জমায়েত করেছিল ব্রিগেডে। কিন্তু ভোটে আসে একটি মাত্র আসন— ভাঙড়। তাও আইএসএফের ঝুলিতে। ফলে এই ব্রিগেডের ভবিষ্যৎ নিয়েও সিপিএমের চিন্তা থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে আগামী নিয়ে আশা করার মতো বার্তাও রয়েছে এই রবিবারের ব্রিগেডে। কারণ, পরের প্রজন্মকে মাঠে নিয়ে এসেছিলেন অনেক বাবা, মা। নবীন প্রজন্মের মিনাক্ষী বলতে উঠতেই হাততালি আর স্লোগানে ফেটে পড়েছে জমায়েত।
এত অমিলের মধ্যে মিলের কষ্ট পেয়েছেন রহমত আলি। ডায়মন্ড হারবারের বাসিন্দা টুপিওয়ালা রহমত কলকাতায় আসেন লাল, নীল, সবুজ যে রঙেরই সমাবেশ হোক না কেন। সেই রবিবারের মতো এই রবিবারও হতাশ করেছে তাঁকে। জানালেন, সকালে থেকে ঘুরে খান দশেক টুপি বিক্রি করতে পেরেছেন। গেরুয়া ব্রিগেডে গীতাপাঠ শুরু হওয়ার পরে মাঠে ঢুকতেই পারেননি রহমত। বললেন, ‘‘সে দিন মিটিং শেষ হলে ঘুরে ঘুরে কয়টা বিক্রি করেছিলাম। আজও তেমনই হল। ধর্মতলায় তৃণমূলেরটায় ভাল বেচেছি।’’ আসলে সেই রবিবারের গুরু গম্ভীর স্তোত্রপাঠ আর এই রবিবারে বাম নেতাদের গনগনে ভাষণ উত্তাপ ছড়ালেও আকাশ ছিল মেঘলা। আর তাতেই মেঘ রহমতের মুখে। বিরক্তিভরা গলায় বললেন, ‘‘এর চেয়ে চিড়িয়াখানাই ভাল।’’