পিছনে চলছে স্টিং অপারেশনের সেই ভিডিও। বিজেপির দলীয় দফতরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। সোমবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি।
সোমবার নয়াদিল্লির প্রেস ক্লাবে ‘নারদ নিউজ’ নামে একটি ওয়েব পোর্টালের পক্ষ থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের এক ঝাঁক নেতানেত্রীর টাকা নেওয়ার ছবি সম্বলিত একটি ভিডিও টেপ প্রকাশ করা হয়। ওয়েব পোর্টালটিতেও ওই ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। আনন্দবাজার সংস্থার পক্ষ থেকে ফুটেজের যথার্থতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। ফুটেজটি ভুয়ো এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অঙ্গ বলে খারিজ করে দিয়েছে তৃণমূল।
নারদ নিউজের অবশ্য দাবি, ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে অভিযোগের আবহে তারা এই স্টিং অপারেশন শুরু করে। কোনও প্রকল্পের জন্য মমতা সরকারের কাছ থেকে ‘সুবিধা’ পেতে পর্দার আড়ালে আসলে কী ঘটে, সেটা বুঝতেই ‘ইমপেক্স কনসালটেন্সি’ নামে একটি ভুয়ো সংস্থা তৈরি করে তারা। ওই সংস্থাকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার আর্জি নিয়ে একাধিক মন্ত্রী ও তৃণমূল নেতার কাছে যান পোর্টালের প্রতিনিধিরা। দু’বছর ধরে চলে এই অপারেশন। যা শুরু হয় বর্ধমানের তৎকালীন পুলিশ সুপার এসএমএইচ মির্জাকে দিয়ে।
প্রসঙ্গত, লোকসভা নির্বাচনের আগে মির্জাকে বর্ধমান থেকে সরিয়ে দেয় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই আইপিএস অফিসারের পাশে দাঁড়ান। ঘোষণা করেন, ভোট মিটলেই মির্জাকে ফেরানো হবে বর্ধমানে। ভোটের পরে সেটাই হয়।
নারদ নিউজের ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, মির্জা বলছেন, তৃণমূলের হয়ে টাকা তোলার তিনিই আসল লোক। তিনি তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের বিশ্বাসভাজন। মুকুল সে সময় তৃণমূলের ‘নম্বর টু’। মির্জার পরামর্শেই মুকুলবাবুর বাড়ি যাওয়া হয় বলে পোর্টালের দাবি। ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, মুকুল তাঁদের মির্জার কাছেই ফেরত পাঠাচ্ছেন।
এর পর একে একে সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সুলতান আহমেদ, সৌগত রায়, শুভেন্দু অধিকারী, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভন চট্টোপাধ্যায়, মদন মিত্র, ইকবাল আহমেদ, ফিরহাদ হাকিমের কাছে পৌঁছেছে স্টিং অপারেশনের দল। পোর্টালটির দাবি সব মিলিয়ে ৫২ ঘণ্টার রেকর্ডিং রয়েছে তাদের কাছে। এ দিন প্রকাশিত হওয়া ২৪ মিনিট ফুটেজের নির্যাস:
এসএমএইচ মির্জা আইপিএস
• মির্জা: ১, ২, ৩, ৪...... (টাকা গোনার পরে) মুকুলদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খোলামেলা।
• স্টিং: লেনদেন ইত্যাদির বিষয়েও?
মির্জা: আমি ইতিমধ্যেই ওঁর জন্য ৬০ জোগাড় করেছি।
• স্টিং: ও কে।
• মির্জা: আজ সকাল আটটা থেকে ওঁকে ফোন করার চেষ্টা করছি। দু’বার ফোন বেজে গিয়েছে। তার পরে এসএমএস পাঠিয়েছি। অন্য এক জনকে পাঠিয়েছি। আপনাদের ঠিক আগেই।
• স্টিং: ঠিক, আমরাও দু’জনকে দেখেছি। ব্রিফকেস হাতে।
• মির্জা: কিন্তু উনি (মুকুল) ওঁদের থেকে টাকা নিতে চাননি। উনি বলেন, ‘মির্জার কাছে যাও। আমি ওখান থেকে নেব।’ কিন্তু আমার কাছেও এত নগদ টাকা রাখা ঠিক নয়।
• স্টিং: উনি (মুকুল) এনফোর্সমেন্ট হানার ভয় পাচ্ছেন, তাই না?
• মির্জা: সেটাই তো উনি বলছিলেন। সামনে নির্বাচন। শুধু এনফোর্সমেন্ট রেড নয়, নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষকও রয়েছেন। তাঁরা যদি জানতে পারেন, তা হলে তো দলটাই লাটে উঠে যাবে।
মুকুল রায় সাংসদ
• মুকুল: এখনই যান এবং কথা বলুন মির্জার সঙ্গে। আমি মির্জার সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি। আমরা বন্ধুর মতো। আপনার বর্ধমানে যাওয়া উচিত। সেখানে আমার এসপি মির্জার সঙ্গে কথা বলুন। ও আমার এবং আপনার মধ্যে মধ্যস্থতা করবে। সব কথাবার্তাই মির্জার মারফত হবে। যাওয়ার আগে মির্জাকে ফোন করে নিন। ওকে গিয়ে এটা দিন। আমার অফিসেও দিতে পারেন। আমি সরাসরি নেব না। আমি আমার লোককে বলে দেব। আপনি ওঁকে গিয়ে দিয়ে দেবেন।
• স্টিং: আপনার অফিসটা কোথায়?
• মুকুল: ৬এ এলগিন রোড। ওখানে এক ঘণ্টা পরে আসুন। ঠিক দু’টো বাড়ি পরে।
• স্টিং: আমার কাছে ২০ লক্ষ আছে।
• মুকুল: ও কে।
• স্টিং: আমি আপনার অফিসে যাব এবং দেব। আপনি থাকবেন তো?
• মুকুল: হ্যাঁ। আমি থাকব।
সুব্রত মুখোপাধ্যায় পঞ্চায়েত মন্ত্রী
• স্টিং: স্যার, এখানে ৪ আছে। আমি পরে আরও এক দেব।
• সুব্রত: ঠিক আছে।
সুলতান আহমেদ সাংসদ
• স্টিং: স্যার, পর পর দু’দিন হোলি থাকায় অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করেছি।
• সুলতান: পাঁচ?
• স্টিং: হ্যাঁ, পাঁচ। সব ১০০০ ও ৫০০ টাকার নোটের ব্যবস্থা করতে গিয়ে সমস্যা হয়েছে। বোঝেনই তো। হাওয়ালা রয়েছে। গত কাল ও আজ এই টাকা জোগাড় করতে হয়েছে। সামনেই নির্বাচন।
• সুলতান: প্রতিদিনই তো খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
• স্টিং: আপনার কী আরও চাই?
• সুলতান: যদি আপনার থাকে।
• স্টিং: আমি আরও ৫ দেব। কিন্তু স্যার, আপনাকে আমাদের দিকটাও দেখতে হবে।
• সুলতান: আপনারা যা চাইবেন, আমি সাহায্য করতে প্রস্তুত। আমার ক্ষমতার মধ্যে। কোনও চিঠি লেখার বিষয়ে, সুপারিশ করার বিষয়ে, কাউকে ফোন করতে হলে আমাকে বলবেন।
• স্টিং: আর স্যার লবিং
এর ব্যাপারটা?
• সুলতান: হ্যাঁ, হ্যাঁ লবিং। আমি সাহায্য করব।
সৌগত রায় সাংসদ
• সৌগত: (হাতে টাকা নিয়ে) এ তো অনেক টাকা!
• স্টিং: এখানে ৪ আছে। আর এই হল হাজারে..... সব মিলিয়ে ৫।
• সৌগত: ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ। (একটু থেমে) আপনারা ইমপেক্স?
• স্টিং: ইমপেক্স কনসালটেন্সি।
• সৌগত: আপনার নাম কী?
• স্টিং: সন্তোষ শঙ্করন।
শুভেন্দু অধিকারী সাংসদ
• স্টিং: ৫ লক্ষ টাকা স্যার।
(শুভেন্দু চোখের ইশারা করেন)
• স্টিং: পাঁচ লক্ষ স্যার।
(কাগজে মোড়া বান্ডিল নিয়ে শুভেন্দু চুপচাপ টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখেন)
কাকলি ঘোষ দস্তিদার সাংসদ
• স্টিং: এখানে চার লক্ষ আছে।
• কাকলি: ঠিক আছে।
• স্টিং: আর কিছু লাগবে?
কাকলি: এই মুহূর্তে নয়।
প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় সাংসদ
• স্টিং: এখানে ৪ লক্ষ আছে।
• প্রসূন কোনও কথা না বলে টাকা তুলে রাখেন।
শোভন চট্টোপাধ্যায় কলকাতার মেয়র ও বিধায়ক
• স্টিং: ৪ লক্ষ টাকা। কাল আরও এক লক্ষ দেব।
• শোভন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে কিছু বলেন (স্পষ্ট শোনা যায়নি)।
• স্টিং: আমাকে আলাপ করিয়ে দিন।
• শোভন: ভোটের পরে আলাপ করিয়ে দেব।
মদন মিত্র তখন পরিবহণ মন্ত্রী, এখন জেলে
• স্টিং: সব মিলিয়ে ৫ লক্ষ।
• মদন: (কাউকে ডেকে) অ্যাই, টাকাটা তুলে রাখ। এখানে এসে ওই আলমারির দরজাটা খোল।
করণ শর্মা এবং সুজয় কৃষ্ণ দু’জনেই যুব তৃণমূল নেতা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ
• সুজয়: এক বার আপনার সঙ্গে অফিসিয়ালি বসব। এখন আনঅফিসিয়ালি বসছি। এখন অফিস ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই। (পরে) আমরা অফিসিয়ালি বসব।
• করণ: আপনারা আসল লোককে খুঁজছিলেন। (সুজয়কে দেখিয়ে) আমি আপনাকে বলছি, উনিই আসল লোক। সাহায্য চাইতে প্রচুর লোক মিস্টার ব্যানার্জি (অভিষেক)-র কাছে আসেন।
• সুজয়: আপনার সঙ্গে বসার পরে আমি মন্ত্রীদের সঙ্গে আপনার বৈঠক ঠিক করে দেব। আপনি সেখান থেকে ইতিবাচক সাড়া পাবেন।
ইকবাল আহমেদ কলকাতার ডেপুটি মেয়র, বিধায়ক
• স্টিং: ২, ৩, ৪, ৫.. আপনি নোটগুলো দেখতে পাচ্ছেন? ১০০০, ৫০০।
• ইকবাল: সুব্রত মুখার্জির টাও দিয়ে দিন। আপনার তো ওঁকে (সুব্রত) আরও এক লক্ষ দেওয়ার কথা আছে।
ফিরহাদ হাকিম পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী
• স্টিং: এটা ছোট কাজ।
• ফিরহাদ: (টাকার অঙ্ক শোনার পরে) আমরা ছোট কাজ হাতে নিতে শুরু করলে বাচ্চারা কী করবে? (একজনকে দেখিয়ে) এঁকে দিয়ে দিন। (সেই ব্যক্তির উদ্দেশে) এদের নীচের ঘরে নিয়ে যাও।
(এ ছাড়া শঙ্কুদেব পণ্ডার সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল স্টিং অপারেশনের টিম। তাদের দাবি, ইমপেক্স কনসালটেন্সি এ রাজ্যে যত প্রকল্পে কাজ করবে, প্রতিটি থেকেই ভাগ চেয়েছিলেন শঙ্কু।)