জয়ের পরে মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু।
এক পাড়ের ফল ১০-০।
অন্য পাড়ের ১২-০।
ভাগীরথীর দু’পারের দুই শিল্পাঞ্চলে এ বারও জোড়াফুলেরই আধিপত্য। শাসকদল শুধু ক্ষমতা ধরেই রাখেনি, বাড়িয়েও নিয়েছে অনেকটা। বিরোধীশূন্য করে দিয়েছে দুই পুরসভাকে।
পূর্ব পারে ব্যারাকপুর-কল্যাণী শিল্পাঞ্চল। পশ্চিম পারে হুগলি শিল্পাঞ্চল। দু’পারের শিল্পাঞ্চলই ধুঁকছে। তবু পুরভোটে শিল্পাঞ্চলের মানুষ কিন্তু আস্থা রেখেছেন তৃণমূলের উপরেই। যা দেখে তৃণমূল নেতাদের দাবি, পুর এলাকায় উন্নয়নের জোরেই এই জয়। বিরোধীদের পাল্টা দাবি, এই জয়ের পিছনে অন্যতম বড় কারণ সন্ত্রাস।
হুগলিতে গঙ্গার পার বরাবর উত্তরপাড়া থেকে বাঁশবেড়িয়া— ১০টি পুরসভা। মোট আসন ২৪৮। তার মধ্যে তৃণমূল পেয়েছে ১৪৩টি। গতবার তারা পেয়েছিল ১৩১টি। অর্থাৎ, তৃণমূল এ বার ১২টি আসন বাড়িয়েছে। ক্ষমতা ধরে রেখেছে ১০টি পুরসভাতেই। অন্য দিকে, ব্যারাকপুর-কল্যাণী শিল্পাঞ্চলে পুরসভার সংখ্যা ১২। মোট আসন ৩১৬। গতবার তৃণমূল পেয়েছিল ২১৪টি। এ বার পেয়েছে ২৭৮টি। ১২টিতেই ক্ষমতা ধরে রাখার পাশাপাশি বিরোধীশূন্য করে দিয়েছে নৈহাটি এবং কল্যাণী পুরসভা।
অবশ্য লড়াইটা এ বার সহজ ছিল না। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল নির্দল-কাঁটা। দলের টিকিট না পেয়ে বা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে দু’পারেই দলের অনেকে নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। এর সঙ্গে ছিল বিজেপি-জুজু এবং সারদা-কাণ্ডে দলের নেতা-মন্ত্রী-সাংসদদের জড়িয়ে পড়া নিয়ে বিরোধীদের লাগাতার প্রচার। দুই শিল্পাঞ্চলেই নিরঙ্কুশ জয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্যই স্বস্তিতে। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁদের চিন্তায় রেখেছে দলের অন্দরের টানাপড়েন। ক্ষমতার ভাগ নিয়ে দলের মধ্যের দ্বন্দ্ব যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়, সেটাই এখন দুই জেলার তৃণমূল নেতৃত্বের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
ভোটের ফলে দেখা যাচ্ছে, কোথাও কোথাও নির্দল-কাঁটা শাসক দলকে বেগ দিলেও জয়রথ থামাতে পারেনি। বিরোধীদের প্রচারও কাজে আসেনি। হুগলির বৈদ্যবাটি এবং বাঁশবেড়িয়া পুরসভায় তৃণমূলের দুই বিদায়ী চেয়ারম্যান অজয়প্রতাপ সিংহ এবং রথীন্দ্রনাথ দাস মোদককে হারতে হয়েছে নির্দলদের কাছে। তবে, তাতে পুরসভা তৃণমূলের হাতছাড়া হয়নি।
যে বিজেপি-জুজু নিয়ে হুগলিতে কিছুটা চিন্তিত ছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব, তা সে ভাবে কাজে আসেনি। গত লোকসভা ভোটের নিরিখে শ্রীরামপুর, রিষড়া, চাঁপদানি, ভদ্রেশ্বরের মতো কিছু এলাকায় কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল বিজেপি। কিন্তু মঙ্গলবার ইভিএম খুলতে দেখা গেল, ১০টি পুরসভায় মাত্র ৬টি আসন পেয়েছে বিজেপি। বামেরা তার চেয়ে বেশি। তৃণমূলের জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘প্রতিটি পুর এলাকায় উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়েছি। তাই বিরোধীরা দাঁত ফোটাতে পারেনি। তবে, জেলা সিপিএম সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরীর দাবি, “লাগাতার সন্ত্রাস না হলে আমরা আরও কিছু আসন বাড়িয়ে নিতে পারতাম।” সাংগঠনিক কথা মেনে নিয়েছেন জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি স্বপন পাল। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের আরও সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে।’’
বিরোধী এবং নির্দলরা একই রকম ধরাশায়ী গঙ্গার অন্য পারেও। রাজনৈতিক শিবিরের কেউ কেউ মনে করছেন, গত পাঁচ বছরে পুর পরিষেবার নিরিখে এবং বিরোধীদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাবে ব্যারাকপুর-কল্যাণী শিল্পাঞ্চলের পুরসভাগুলি নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছে তৃণমূল। তবে, প্রধান বিরোধী হিসেবে বামেরা যে এখানে কার্যত মুছে যাবে, তা ভাবতে পারছেন না অনেকেই।
নৈহাটি পুরসভার ৩১টি ওয়ার্ডই তৃণমূল দখলে রেখেছে। কল্যাণীতেও তারা ২১টি ওয়ার্ডই জিতে নিয়েছে। এই একতরফা জয়ে নৈহাটির তৃণমূল বিধায়ক পার্থ ভৌমিকের খোঁচা, ‘‘অন্তত একটি দু’টি আসন সিপিএম পাবে বলে নিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু সিপিএম শুধু ঘরে বসেই অভিযোগ করল। প্রতিদ্বন্দ্বিতা কি ঘরে বসে হয়?’’
একমাত্র ব্যারাকপুর পুরসভার পাঁচটি ওয়ার্ড এ বারও ধরে রাখতে পেরেছে বামেরা। কামারহাটিতে পেয়েছে পাঁচটি। বাকিগুলির কোনওটিতে একটি, কোনওটিতে বা দু’টি আসন। কংগ্রেস এবং বিজেপি কার্যত নিশ্চিহ্ন। ফলাফলে হতাশা গোপন করেননি ব্যারাকপুরের সিপিএম নেতা তড়িৎ তোপদার।
তবে, একই সঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘মানুষ কি সত্যিই ভোট দিল এ বার?’’ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘যে ভাবে উন্নয়ন হয়েছে, তাতে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আমাদের ভোট দিয়েছেন।’’