পড়ে আছে মর্তুজা শেখের দেহ। সোমবার নানুরে।
পতাকার রংটাই যা বদলেছে। বদলায়নি নানুর।
নানুরের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাসের নাম। আজ সেই জনপদের পরিচিতি বীরভূমে বোমা-বারুদ-রাজনৈতিক হানাহানির আঁতুড়ঘর হিসেবে! সেই পনেরো বছর আগে সূচপুর গণহত্যা দিয়ে এ রাজ্যের রাজনৈতিক খুনোখুনির মানচিত্রে নাম তুলেছিল নানুর। তার পর থেকে গড়বেতা, কেশপুর, গোঘাট, চমকাইতলার সঙ্গে বরাবর এক সারিতে থেকেছে তারা। সোমবার দিনেদুপুরে রাস্তার উপরে অ্যাম্বুল্যান্স চেপে এসে তিন তৃণমূল কর্মীকে খুনের ঘটনা ফের জানান দিল— পরিবর্তনেও বদলায়নি কাহিনি। নানুর আছে নানুরেই!
প্রথমে সিপিএমের সঙ্গে শরিক দলগুলি, তার পরে সিপিএম বনাম তৃণমূল এবং এখন তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব— নানুরে সন্ত্রাসের রং এ ভাবেই বদলেছে। কিন্তু কীসের টানে এলাকা দখলে এত মরিয়া রাজনৈতিক দলগুলো, যার ফলে এত হানাহানি? স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষের কথায়, এর মূল কারণ ধান-চালের আড়ত আর বালিঘাটের দখলদারি।
সাম্প্রতিক ইতিহাস টেনে তাঁরাই বলছেন, বছর দশেক আগেও ‘লাল দুর্গ’ হিসেবেই পরিচিত ছিল নানুর। এলাকা দখলকে ঘিরে তখন বামেদের শরিকি সংঘর্ষে (কখনও সিপিএম-ফরওয়ার্ড ব্লক, কখনও সিপিএম-আরএসপি) বারবার তেতে উঠেছে নানুরের জমি। সূচপুর, পাপুড়ি, থুপসড়া, সাকুলিপুর— হানাহানির মুক্তাঞ্চলের তালিকাটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। গ্রাম দখল ও বিশ্বাসঘাতকতার এই দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে বাড়ি পোড়ানো, লুঠপাট, বোমাবাজি, গুলি কিছুই বাদ যায়নি। লোকসভা থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত— নানুরে একচেটিয়া আধিপত্য ছিল সিপিএমের। কয়েকটি মাত্র পঞ্চায়েতে ছিল শরিক দলের প্রভাব। ওই সব পঞ্চায়েতের দখল নিয়েই সিপিএমের সঙ্গে শরিকদের সংঘর্ষে দিনের পর দিন অশান্ত হয়ে উঠত নানুরের একের পর এক গ্রাম। তখন দাসকলগ্রাম, কড়েয়া ১ ও ২ পঞ্চায়েতে প্রভাব ছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের। ওই দলের দুই দাপুটে নেতা অভিজিৎ ওরফে রানা সিংহ (অধুনা তৃণমূলে) এবং তাঁরই সম্পর্কিত ভাই বিশ্বজিৎ ওরফে কর্পূরের দাপটে ওই দুই পঞ্চায়েত এলাকায় সিপিএম দীর্ঘদিন কোণঠাসা ছিল। শুধু এই সব জায়গাই নয়, নিজেদের আধিপত্য কায়েম করতে দাসকল, পাটনীল, পলশা প্রভৃতি গ্রামেও ফব-র সঙ্গে ধারাবাহিক সংঘর্ষে জড়িয়েছে সিপিএম। দু’দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক তো বটেই, প্রাণ গিয়েছে একাধিক নিরীহ গ্রামবাসীর। দিনের পর দিন গ্রামছাড়া হয়েও থাকতে হয়েছে বহু পরিবারকে। একই ভাবে গ্রাম দখলকে কেন্দ্র করে আর শরিক আরএসপি-র সঙ্গে সিপিএমের সংঘাত বেঁধেছে বড়া-সাওতা, জলুন্দি, নওয়ানগর-কড্ডা প্রভৃতি পঞ্চায়েত এলাকায়।
নানুরে যে একেবারে তৃণমূলের কোনও ভিত্তি ছিল না, তা নয়। তলায় তলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের প্রতি নানুরের বিভিন্ন এলাকায় সমর্থনের একটা চোরাস্রোত ছিলই। তারই জেরে ২০০০ সালে সূচপুরে সিপিএমের হাতে ১১ জন তৃণমূল সমর্থক খেতমজুর খুন হন বলে অভিযোগ। ওই ঘটনা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তুলে প্রথম নানুরের মাটিতে দাঁত ফোটাতে শুরু করে এখনকার শাসকদল। ২০০৩ সালে প্রথম থুপসড়া ও চারকলগ্রাম পঞ্চায়েতে বিজেপি, কংগ্রেসকে নিয়ে বোর্ড গড়ে তৃণমূল। ওই পঞ্চায়েত এলাকার দখল-পুনর্দখলকে কেন্দ্র করে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষে বারবার অশান্ত হয়ে ওঠে বাসাপাড়া, থুপসড়া, পালুন্দি, পাপুড়ি প্রভৃতি গ্রাম। দিনের পর দিন পরিবার সমেত গ্রামছাড়া থাকতে হয় পাপুড়ির বাসিন্দা, বর্তমানে কেতুগ্রামের বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজ ও তাঁর ভাই কাজল শেখ (সোমবারের তিন খুনের অন্যতম অভিযুক্ত)-সহ বহু তৃণমূল কর্মী-সমর্থককে। এরই মধ্যে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে খুন হন সাহানেওয়াজের দুই ভাই এবং সেই সময়কার দাপুটে নেতা মুন্সি নুরুল ইসলাম ওরফে সোনা চৌধুরী-সহ বহু তৃণমূল নেতা-কর্মী-সমর্থক। উল্টো দিকে, প্রাণ গিয়েছে নানুরের প্রাক্তন বিধায়ক আনন্দ দাস-সহ সিপিএমের অনেক কর্মী-সমর্থকেরও।
হাওয়াটা পুরোপুরি ঘুরতে শুরু করে ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকে। সে বার নানুর বিধানসভা এলাকায় সিপিএমের ভোটে ভাল রকম থাবা বসায় তৃণমূল। তার উপরে বিভিন্ন সময় সিপিএমের বিভিন্ন শরিক দলের নেতা-কর্মীরাও নাম লেখাতে শুরু করেন তৃণমূলে। ২০১১ সালে নানুর বিধানসভা কেন্দ্রটিও তৃণমূল ছিনিয়ে নেয়। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদের একটি আসনে ছাড়া গোটা এলাকায় কোথাও কোনও প্রার্থীই দিতে পারেনি বামেরা। তাদের মেরুদণ্ড এমনই ভেঙে দিয়েছিল তৃণমূল (আরও নির্দিষ্ট করে বললে কাজল শেখের দলবল)! গত বছর লোকসভা ভোটেও সেই ধারা অব্যাহত থেকেছে। শুধু নানুর বিধানসভা থেকেই ৬০ হাজারেরও বেশি লিড পেয়েছিল তৃণমূল।
নানুরে দল আড়েবহরে যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে নিজেদের দ্বন্দ্ব। কেন? স্থানীয়রা বলছেন, গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে বরাদ্দ টাকার একটা অংশ হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নানুরের প্রান্ত ছোঁয়া বর্ধমান লাগোয়া অজয় নদের বালিঘাট দখল নিয়েও চলে সংঘর্ষ। ‘‘একে তো দলে বেনোজল ঢুকেছে। তার উপরে কিছু নেতারও ক্ষমতা আর টাকার লোভে মাথা ঘুরে গিয়েছে! তারা জানে, পঞ্চায়েত আর বালিঘাটের দখল নিজেদের হাতে রাখলে আর যাই হোক, কাঁচা টাকার আমদানির কোনও অভাব কখনও হবে না।’’—মঙ্গলবার দুপুরে ফোনে আক্ষেপ করছিলেন নানুরের এক প্রবীণ তৃণমূল কর্মী। যিনি বছরের পর বছর সিপিএমের হাতে মার খেয়ে আর ঘরছাড়া থেকে তৃণমূল করেছেন।
নানুর ব্লক তৃণমূল সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্যও মানছেন, মূলত অর্থনৈতিক বিষয় ঘিরেই এই বিরোধ। তাঁর কথায়, ‘‘এখানে অন্য কোনও জীবিকার সুযোগ নেই। তাই সিপিএমের আমল থেকেই কিছু দুষ্কৃতী বালিঘাট, পঞ্চায়েত এবং বাসাপাড়া এলাকায় ধান চালের আড়তের দখলদারি চালাত। ওদেরই একাংশ এখন আমাদের দলে ঢুকে একই দুষ্কর্ম করছে।’’ সিপিএমের নানুর জোনাল সম্পাদক হাসিবুর রহমানের আবার দাবি, ‘‘আমাদের দলের কেউ ওই ধরনের কাজে যুক্ত ছিল না। তৃণমূলের দু’টি গোষ্ঠী তখনও নিজেদের মধ্যে মারামারি করত। এখনও করছে।’’ যা শুনে সুব্রতবাবুর কটাক্ষ, ‘‘হাসিবুর সাহেব বোধহয় ভুলে গিয়েছেন, তিনি যে সময়ের কথা বলছেন, তখন তৃণমূল বলে কোনও কিছুর অস্তিত্বই ছিল না নানুরে!’’
সোমবার বোলপুর-পালিতপুর সড়কে মুলুক গ্রামের কাছে নানুরের বিধায়ক গদাধর হাজরার অনুগামী তিন তৃণমূল কর্মী খুন হওয়ার ঘটনা ফের বেআব্রু করে দিয়েছে এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকেই। নিহত কুরবান শেখের পরিবার কাজল শেখ ও তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ এনেছে। কুরবান ছিলেন কাজল-বিরোধী গদাধরের ঘনিষ্ঠ। নাম করতে না-চাওয়া এলাকার অনেকেই বলছেন, রাজায় রাজায় যুদ্ধে এ ভাবেই উলুখাগড়ার প্রাণ যায়!
সোমবার যে সময়ে তিন খুনের ঘটনা ঘটেছে, তখন বিধানসভায় বীরভূমের পর্যবেক্ষক তথা পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে বৈঠকে ব্যস্ত কাজল শেখ ও গদাধর হাজরা। যুযুধান দুই নেতা এক সঙ্গেই কলকাতা গিয়েছিলেন। ফিরেছেন অবশ্য আলাদা ভাবে।
হয়তো নানুরে নিজেদের ফাটল আরও চওড়া হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েই!