গন্ডগোল ঠেকাতে ভাঙড়ের কাঁঠালিয়া হাইস্কুলের সামনে প্রস্তুত পুলিশ ও বাহিনী। মঙ্গলবার রাতে। —নিজস্ব চিত্র।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকের সন্ত্রাসের অভিযোগে সব চেয়ে বেশি সরব বিজেপি। কিন্তু সন্ত্রাসের ভূরি ভূরি অভিযোগ তোলা সত্ত্বেও বিরোধীদের মধ্যে পঞ্চায়েতে সব চেয়ে বেশি আসন পেয়েছে তারাই। এ বার গ্রাম পঞ্চায়েতে ১০ হাজারের বেশি আসন জিতেছে তারা, যা এ রাজ্যে এখনও পর্যন্ত বিজেপির পক্ষে রেকর্ড জয়। গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় বিজেপির ভোট প্রায় ১৫% কমেছে, কমে এসেছে প্রভাবের এলাকাও। কিন্তু ‘সন্ত্রাস এবং প্রহসনে’র পঞ্চায়েত ভোটে লড়ে যা আসন বার করা গিয়েছে, তা-ই লোকসভা নির্বাচনের আগে কর্মীদের বাড়তি মনোবল জোগাবে বলে মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
এ বার কয়েকটি জেলা পরিষদে জয়ের বিষয়ে আশাবাদী ছিল বঙ্গ বিজেপি। বিশেষত, উত্তরবঙ্গের অন্তত দু’টি জেলা পরিষদে বিজেপির জয়ের সম্ভবনা নিয়ে চর্চা ছিল রাজনৈতিক শিবিরেও। তবে বাস্তবে দেখা গিয়েছে, সেই সব জায়গায় কার্যত শূন্য হয়ে গিয়েছে বিজেপি। একমাত্র পূর্ব মেদিনীপুর ছাড়া জেলা পরিষদে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে দাঁত ফোটাতে পারেনি তারা। দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের দাবি, ‘‘ভোট হয়ে যাওয়ার পরেও ওই সব জেলায় ভোট লুট হয়েছে। মালদায় আমরা ধরেছিলাম। বাকি জায়গায় ধরতে পারিনি। তাই ভোটের ফল বদলে গিয়েছে। লোকসভা নির্বাচনে ওই জেলাগুলিতে ফলাফল সম্পূর্ণ পাল্টে যাবে। বিজেপি ব্যাপক ব্যবধানে জিতবে।”
গত পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে লোকসভা, বিধানসভা নির্বাচনে জনজাতি, মতুয়া, রাজবংশী অধ্যুষিত এলকায় একচেটিয়া ভোট পেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু দেখা গেল, এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচন ওই এলাকাগুলিতে বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে ধস নেমেছে। মতুয়া অধ্যুষিত নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলা, বনগাঁ সাংগঠনিক জেলায় বিজেপির ফল খারাপ হয়েছে। ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মতো জনজাতি অধ্যুষিত জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতেও বিজেপির ঝুলি কার্যত খালি। এমনকি, রাজবংশী অধ্যুষিত কোচবিহার, জনজাতি অধ্যুষিত আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়িতেও প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে বিজেপি। এর কারণ কি শুধুই সন্ত্রাস, সেই প্রশ্ন ঘুরছিল রাজনৈতিক মহলেও। কারণ, নির্বাচনের দিন কোচবিহারের কয়েকটি জায়গা বাদে উত্তরের বাকি জেলাগুলো থেকে সে ভাবে শাসক সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠেনি। সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ বিজেপির এক বর্ষীয়ান নেতার বক্তব্য, “জাতিসত্তার রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে কোনও দিনই গ্রহণযোগ্য ছিল না। অতিরিক্ত জাতিসত্তার রাজনীতি করতে গিয়েই বুমেরাং হল! হিন্দু উদ্বাস্তু ও জনজাতি, উপজাতি বিজেপির চিরাচরিত ভোট ব্যাঙ্ক। অতিরিক্ত জাতিসত্তার রাজনীতি করতে গিয়ে সেই ভোট আমরা হারিয়েছি।”
পঞ্চায়েত নির্বাচনকে লোকসভা নির্বাচনের মঞ্চ প্রস্তুতি হিসেবে দেখেছিল বিজেপি। তাই লোকসভা নির্বাচনের আগে নিচু তলায় দলের শক্তি যাচাইয়ের কাজ সেরে নিতে চেয়েছিল তারা। বছর ঘুরলেই লোকসভা নির্বাচন। তার আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলের শক্তি আদৌ ‘পাশ নম্বর’ পেল কি না, সেই প্রশ্নে খুব নিশ্চিত নন দলীয় নেতৃত্ব। রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এই নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে কোনও ভাবেই রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। তবু কিছু জায়গায় সাংগঠনিক ত্রুটি সামলে আমরা লোকসভার লড়াইয়ে নামব।” যদিও সুকান্তর দাবি, “পঞ্চায়েত, বিধানসভা, লোকসভা তিনটি নির্বাচন ভিন্ন প্রেক্ষিত, ভিন্ন পরিস্থিতিতে হয়। তাই কোনও নির্বাচনের ফলাফল দিয়েই অন্য কোনও নির্বাচনের প্রস্তুতিকে বোঝা সম্ভব নয়। তবে আমরা ২২-২৫% ভোট পেয়েছি। রাজ্যে ২০০৮ সালে তৃণমূলও প্রায় একই রকম ভোট পেয়ে ২০১১ সালে সরকার গড়েছিল। তাই আমরা আশাবাদী।”
একদিকে বাংলায় বিজেপি নিজেদের সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন জিতেছে, অন্য দিকে বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় ভোট শতাংশ বেশ খানিকটা হারিয়েছে। এই দুইয়ের দোলাচলে পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে কী প্রাপ্তি হল বিজেপির, সেই নিয়ে চর্চা চলছে দলের অন্দরে। যদিও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এই বিশ্লেষণে যেতেই নারাজ। তাঁর মতে, ‘‘আমরা যতটা পেরেছি, প্রার্থী দিয়েছি। দল ৪৭ হাজার আসনে লড়েছে। জিতলেও গ্রাম পঞ্চায়েতে আমাদের প্রায় তিন হাজার প্রার্থীর শংসাপত্রই দেওয়া হয়নি! আমরা তালিকা করছি। এই ফলকে আমরা গ্রহণ করি না, মানুষও করে না!’’ তাঁর দাবি, ‘‘লোকসভায় মানুষ জবাব দেবেন। রাস্তায় এখন লড়াই হবে।’’