শুভেন্দু অধিকারী। ফাইল চিত্র।
পূর্ব মেদিনীপুরের ময়নার বাকচায় বিজেপি নেতার মৃত্যু ঘিরে সরগরম রাজ্য-রাজনীতি। এই পরিস্থিতিতে সেই বাকচাকেই নিজেদের শক্ত ঘাঁটি বানিয়ে লোকসভার প্রস্তুতি নিতে চাইছে বিজেপি! ভোটের অঙ্কের নিরিখে তা-ই লিখেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। সেই একই কথা শোনা গেল বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মুখেও। তিনি বলেন, ‘‘সামনের লোকসভা নির্বাচনে এই বাকচার অবদান সব চেয়ে বেশি হবে। তাই এখান থেকে আমরা সরছি না।’’ হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়ে দিলেন, সময় মতো গণআন্দোলনেরও প্রস্তুতি নেওয়া হবে।
শুভেন্দুকে পাল্টা কটাক্ষ করেছেন কুণাল ঘোষ। তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘গণআন্দোলনে নামতে গেলে মানুষকে লাগে। মানুষ এখন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনজোয়ারে রয়েছে। বিজেপির নীতি হল গণহত্যা। গণআন্দোলন ওদের অভিধানে নেই।’’
নন্দীগ্রাম, খেজুরির জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের রাজনীতিতে এখন নতুন ভরকেন্দ্র হয়ে উঠতে শুরু করেছে বাকচা। বাকচার গোড়ামহল গ্রামে সোমবার বিকেলে বিজয়কৃষ্ণ ভুঁইয়াকে অপহরণ করে খুনের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনার প্রতিবাদে বুধবার ১২ ঘণ্টা ময়নায় বন্ধ কর্মসূচি পালন করেছেন বিজেপি কর্মীরা। বৃহস্পতিবার ময়নায় বিজেপির মিছিল হয়। মিছিলের পর নিহত দলীয় নেতার স্মরণসভায় যোগ দিয়ে শুভেন্দু বলেন, ‘‘বাকচায় প্রতিনিয়ত আমরা বিধায়ক, জেলা নেতৃত্বকে রাখব। এই বাকচার জন্যই আমরা অশোক (অশোক দিন্দা)-কে বিধানসভায় জেতাতে পেরেছি। বাকচা একাই ১২ হাজার লিড দিয়েছিল। সেই কারণেই আমরা এখানে জিততে পেরেছি। আগামী লোকসভায় তমলুক কেন্দ্রে আমরা যে জিতব, তাতে বাকচার অবদান সব থেকে বেশি থাকবে। গোটা ময়নার অবদানই থাকবে বলে আমরা মনে করি।’’
প্রসঙ্গত, ময়না বিধানসভা তমলুক লোকসভার অন্তর্গত। গত লোকসভা নির্বাচনে এই আসনে তৃণমূলের দিব্যেন্দু অধিকারী জিতেছিলেন ১,৯০,১৬৫ ভোটে। বিজেপি ৩৭.২ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছিল। কিন্তু দিব্যেন্দুর দাদা শুভেন্দু তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার জন্য তমলুকের হিসাবও বদলে যায়। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে তমলুকে বিজেপি পিছিয়েছিল মাত্র ২১ ভোটে। ওই লোকসভা এলাকার সাতটি বিধানসভা মিলিয়ে তৃণমূল ভোট পেয়েছে ৭,১৪,৩৯৮টি। সেখানে বিজেপির প্রাপ্তি ৭,১৪,৩৭৭ ভোট। দুই দলের ভোটপ্রাপ্তির হার যথাক্রমে ৪৬ শতাংশ এবং ৪৫.৯ শতাংশ।
নিহত বিজয়কৃষ্ণকে ‘নমঃশূদ্র’ সম্প্রদায়ের বলে উল্লেখ করে শাসকদলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাচ্ছেন শুভেন্দু এবং বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারেরা। অনেকেই মনে করছেন, এই পরিচয় প্রকাশ্যে আনা এবং বিজেপির ময়নার মাটি আঁকড়ে থাকার পিছনে রাজনীতির অঙ্ক রয়েছে। কারণ, কাঁথি এবং তমলুক লোকসভা আসনের জন্য ময়না অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই আসনটি ‘সংরক্ষিত’ না হলেও এখানে বড় সংখ্যায় তফসিলি জাতির মানুষের বাস। সেই সঙ্গে বড় সংখ্যায় রয়েছেন অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষও। যেমন ছিলেন সদ্যমৃত ৬০ বছরের বিজয়কৃষ্ণও। বৃহস্পতিবারও শুভেন্দু বলেন, ‘‘আমি আছি তো এখানে। ২০০৭ সাল থেকে এখানে আছি। ২০ বছর হয়ে গেল, এলাকা চিনি। দলিতের রক্ত, হবে না কো ব্যর্থ। নমঃশূদ্রের রক্ত, হবে না কো ব্যর্থ।’’
শুভেন্দুর অভিযোগ, শাসকদলের কয়েক জন নেতার উস্কানিতেই পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে বিজয়কৃষ্ণকে। বিরোধী দলনেতা বলেন, ‘‘এই হত্যায় উস্কানি দিয়েছেন তৃণমূলের গুটিকয় নেতা। কিছু দিন আগে বাকচায় সৌমেন মহাপাত্রের নেতৃত্বে একটা সভা হয়েছিল। আমাদের পাল্টা সভা। সেখানেই ভূরি ভূরি উত্তেজক মন্তব্য করে এলাকা অশান্ত করা হয়েছে।’’ সিবিআই তদন্তের দাবিতে শুভেন্দু বলেন, ‘‘আদালত এখানে কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দেন কি না, আমরা সে দিকে নজর রাখছি। আইনের উপর আমাদের আস্থা আছে। যদি কেন্দ্রীয় এজেন্সি তদন্ত করে, তা হলে আমরা সব রকম সহযোগিতা করব। সাক্ষীদেরও আমরা সমস্ত রকম সহযোগিতা করব। আর আমাদের যদি গণআন্দোলনে নামতে হয়, তা হলে তার জন্য দেরি আছে। সময় মতো আমরা এর জন্য প্রস্তুতি নেব।’’
শুভেন্দুর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে তমলুক জেলা তৃণমূলের সভাপতি সৌমেন মহাপাত্র বলেন, “যে কোনও মৃত্যুই মর্মান্তিক। যারা দোষ করেছে, আইন তাদের শাস্তি দেবে। কিন্তু বাকচার রাজনৈতিক রাশ ধরে রাখাই যে বিজেপির আসল উদ্দেশ্য, তা শুভেন্দু নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন। বিজয়কৃষ্ণের মৃত্যু আসলে বিজেপির গোষ্ঠীকোন্দলের ফসল হতে পারে বলেই আমাদের ধারণা। অথচ এই ঘটনা নিয়ে তৃণমূলকে বার বার টেনে এনে মিথ্যে অভিযোগে ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে। মানুষ সব দেখছেন। শুভেন্দুর রাজনৈতিক অভিপ্রায় ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’’ কুণালও বলেন, ‘‘বাকচার হত্যাকাণ্ডে শুভেন্দু অধিকারী জড়িত কি না, তা তদন্ত করে দেখা উচিত। কারণ পুরনো ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, শুভেন্দু অধিকারী নাম করে বিজয়কৃষ্ণকে হুমকি দিচ্ছেন। বলছেন, ব্লিচিং পাউডার দিয়ে শেষ করে দেব। সেই ভিডিয়ো আমরা ইতিমধ্যেই সামনে এনেছি। এটা আদি বিজেপি এবং নব্য বিজেপির সঙ্ঘাত। শুভেন্দু আগে তৃণমূলে ছিল। এখন বিজেপিতে গিয়েছে। তেলেজলে মিলতে না পারার কারণেই কি এই ঘটনা, তা তদন্ত করে দেখা উচিত। নজর ঘোরানোর জন্য শুভেন্দু নাটক করছেন!’’ সিবিআই তদন্তের দাবির প্রেক্ষিতে তাঁর সংযোজন, ‘‘সিবিআই চাইছে, কারণ সিবিআই তদন্ত করলে ওরা বেঁচে যাবে তো। সিবিআইয়ের এফআইআরে শুভেন্দুর নাম রয়েছে। তার পরেও সিবিআই শুভেন্দুকে ধরছে না।’’