জনজাতি সাংসদদের সামনে রেখে ডেউচা-পাচামিতে বিক্ষোভের নেতৃত্ব হাতে নিতে চাইছে বিজেপি। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিজেপি সাংসদের চিঠি পৌঁছেছিল আগেই। এ বার শুরু হয়ে গেল ডেউচা-পাচামিতে ‘প্রতিরোধ’ গড়ে তোলার তোড়জোড়ও।
‘প্রতিরোধ’ শব্দটা ব্যবহার করছেন বিজেপি নেতারা। সুবিশাল কোল ব্লক থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু করার জন্য রাজ্য সরকার যে পথে এগোচ্ছে, তাতে স্থানীয় জনজাতীয় বাসিন্দারা বিপর্যয়ের মুখে পড়বেন বলে অভিযোগ তুলে ক্রমশ সুর চড়াতে শুরু করেছে বিজেপি। জনজাতি গোষ্ঠীভুক্ত ৩ সাংসদ এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি গঠন করার তোড়জোড়ও শুরু হয়েছে। অনেকটা নন্দীগ্রামের ধাঁচে এগোতে চাইছে বিজেপি। পরিস্থিতির দিকে এবং বেশ কয়েক জন বিজেপি নেতার গতিবিধির উপরে সতর্ক নজর রাখছে প্রশাসনও।
১৮ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৈঠক সেরে বেরিয়ে জানিয়েছিলেন যে, বীরভূমের ডেউচা-পাচামি কোল ব্লক থেকে কয়লা উত্তোলন প্রকল্পের সূচনা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা কাটার আগেই বাঁক নেয় ঘটনাপ্রবাহ। বিজেপির বাঙালি সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত ১৯ সেপ্টেম্বর সকালেই চিঠি পাঠান প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সে চিঠিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিমন্ত্রণ স্বীকার না করার অনুরোধ জানানো হয় মোদীকে।
আরও পড়ুন: বুলবুল গেলেও দিঘাতে পর্যটকদের সমুদ্রে নামা নিষিদ্ধ করল প্রশাসন
দুর্গাপুজোর পরেই ডেউচা-পাচামি প্রকল্পের উদ্বোধনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু স্বপন দাশগুপ্ত প্রধানমন্ত্রীকে লেখেন, ‘‘আমার মনে হয়, দুর্গাপুজোর পরে ওই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে আপনার উপস্থিতি সব রকমের ভুল বার্তা দিতে পারে।’’ প্রধানমন্ত্রীকে ওই বিজেপি সাংসদ জানিয়েছিলেন, ডেউচা-পাচামি প্রকল্পের পরিকল্পনা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং প্রকল্পটির সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব কেমন হতে পারে, তা খতিয়ে দেখাই হয়নি। পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়নি বলে মোদীকে জানিয়েছিলেন স্বপন। চিঠিতে তিনি আরও লিখেছিলেন, ডেউচা-পাচামি এলাকা জনজাতি প্রধান এবং তাঁদের উপযুক্ত পুনর্বাসন দেওয়ার পরিকল্পনা বা নীতি এখনও ঘোষিত হয়নি। তাই জনজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে ক্ষোভ রয়েছে।
এত রকমের সমস্যা আড়াল করে তড়িঘড়ি প্রকল্প চালু করার জন্যই প্রধানমন্ত্রী মোদীকে সামনে রাখতে চাইছেন মমতা— বিজেপি এই রকমই ইঙ্গিত দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভের দায় বিজেপির ঘাড়ে চাপিয়ে দিতেও তৃণমূলের সুবিধা হবে— এমন আলোচনাও সে সময়ে শুরু হয়েছিল বিজেপির অন্দরে।
পরিস্থিতিও ক্রমশ সে দিকে গড়িয়েছে। ডেউচা-পাচামির জনজাতি তালুকে বড়সড় ক্ষোভ দানা বেঁধেছে। নন্দীগ্রামের ক্ষোভকে যে ভাবে তৎকালীন শাসকদের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়েছিল তৃণমূল, ঠিক সেই ভাবেই ডেউচা-পাচামির ক্ষোভকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে তৎপর হয়েছে বিজেপি।
আরও পড়ুন: বুলবুলে বিধ্বস্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনায় মুখ্যমন্ত্রী, ক্ষত সারাতে দ্রুত ব্যবস্থার নির্দেশ জেলা প্রশাসনকে
বীরভূমের ওই এলাকা থেকে জনজাতি সম্প্রদায়ের কয়েক জন প্রতিনিধি সম্প্রতি কলকাতায় এসে দেখা করে গিয়েছেন বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে। বিজেপি-ও সব রকম ভাবে স্থানীয় দাবি-দাওয়াকে সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছে বলে খবর। জনজাতি সম্প্রদায় থেকে আসা ৩ বিজেপি সাংসদকে সামনে রাখছে বিজেপি— ঝাড়গ্রামের কুনার হেমব্রম, পুরুলিয়ার জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো এবং উত্তর মালদহের খগেন মুর্মু। জীবন-জীবিকা রক্ষা কমিটি বা ওই রকম কোনও নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলার আয়োজন শুরু হয়েছে। শুধু জনজাতি সাংসদরা নন, মুকুল রায়, স্বপন দাশগুপ্ত, শঙ্কুদেব পন্ডারাও সেই কমিটির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন বলে খবর। স্থানীয় দাবি-দাওয়ার প্রতি সমর্থন জানিয়ে ডেউচা-পাচামিতে ওই কমিটির ব্যানারে সভা করা হতে পারে, জানা যাচ্ছে বিজেপি সূত্রে। তার পরে জনজাতি সম্প্রদায়ের দাবি-দাওয়া নিয়ে বিজেপি নেতারা রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের দ্বারস্থ হতে পারেন।
জনজাতি বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া বা এলাকার বাসিন্দাদের নিয়ে কমিটি গঠন করার আয়োজন যে শুরু হয়ে গিয়েছে, সে কথা বিজেপি নেতারা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করেননি। তবে রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসুর কথায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, ডেউচা-পাচামিতে ক্ষোভের আঁচ যে ঘনীভূত হচ্ছে, তাতে বিজেপি অক্সিজেন জোগাচ্ছে। সায়ন্তন এ দিন আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘ডেউচা-পাচামি প্রকল্প রূপায়ণের সঙ্গে জনজাতি সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি জড়িত। সুতরাং দুই সরকারকেই অত্যন্ত ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ করতে হবে।’’ কেন্দ্র যা করার, ভেবেচিন্তেই করবে বলে তাঁর দাবি। জনজাতি সম্প্রদায় পুনর্বাসন সংক্রান্ত যে দাবি তুলছে, তাতে বিজেপির পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বলেও তিনি এ দিন আন্দবাজারকে জানিয়েছেন। সায়ন্তনের তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘আমরা ইতিমধ্যেই ওখানে রয়েছি। ওঁদের সব দাবি-দাওয়ার পাশে দাঁড়ানোর কাজ বিজেপি ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে।’’
প্রায় একই কথা শোনা গিয়েছে বীরভূম জেলা বিজেপির সভাপতি রামকৃষ্ণ রায়ের মুখে। ডেউচা-পাচামিতে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বলে তিনিও দাবি করেছেন। তার পরেই বলেছেন, ‘‘বিজেপি ইতিমধ্যেই ওখানে কাজ শুরু করেছে।’’
বিজেপির এই তৎপরতার খবর কিন্তু রাজ্য প্রশাসনের কাছেও রয়েছে। ডেউচা-পাচামিকে ঘিরে বিজেপি ঠিক করতে চাইছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর প্রশাসন রাখার চেষ্টা করছে। বিজেপি নেতাদের দাবি, তাঁদের উপরে নজরদারি শুরু করেছে প্রশাসন। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হতে পারে, এমন আশঙ্কাও কেউ কেউ করছেন। বিজেপির যুবনেতা শঙ্কুদেব পন্ডা বলেন, ‘‘মুকুল রায়, স্বপন দাশগুপ্ত-সহ অনেকের ফোনেই আড়ি পাতা হচ্ছে। তাঁদের গতিবিধির উপরে নজর রাখা হচ্ছে। ডেউচা-পাচামিতে নিজেদের ইচ্ছে মতো যদি এগোতে না পারে রাজ্য সরকার, তা হলে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলে আমাদের নেতাদের গ্রেফতারও করা হতে পারে, এমনও আমরা শুনছি।’’ বীরভূম জেলা প্রশাসন অবশ্য কারও উপরে গোপনে নজরদারি চালানোর অভিযোগ সম্পূর্ণ নস্যাৎ করেছে।
আরও পড়ুন: মন্দার শিকড় আরও গভীরে! বিদ্যুতের চাহিদা ১২ বছরে সবচেয়ে কম
রাজ্য সরকারের তরফে অবশ্য ডেউচা-পাচামি নিয়ে এখন খুব বেশি কথা বলা হচ্ছে না। তৃণমূলও নীরব। পুজোর পরে উদ্বোধন হতে পারে বলে সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু পুজোর পরে এক মাসেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত। কয়লা প্রকল্পটি নিয়ে রাজ্য সরকারের তরফে খুব একটা তৎপরতা এখন চোখে পড়ছে না।