বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।
এ বারের পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে চর্চিত বিষয় হয়ে উঠেছে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’। মহিলাদের জন্য ওই প্রকল্পের ‘সুফল’ দেখিয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই ভোট চাইছে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু ‘খয়রাতির রাজনীতি’ নিয়ে তাদের আগের অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ ঘুরে গিয়ে মহিলাদের জন্য মাসিক দু’হাজার টাকা আর্থিক সহায়তার কথা বলছে বিজেপিও। প্রশ্নের মুখে নানা ব্যাখ্যা দিলেও ভোট টানতে অনুদানের রাজনীতি যে তাঁদেরও হাতিয়ার, বোঝা যাচ্ছে বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্যেই। কংগ্রেসও তাদের পঞ্চায়েত ইস্তাহারে মহিলাদের স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা সহায়তার দাবি তোলার কথা বলেছে। বিরোধীদের এমন অবস্থান দেখে এখন কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না শাসক দল।
পঞ্চায়েতের প্রচারে নদিয়ায় গিয়ে মঙ্গলবার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ফের বলেছেন, ক্ষমতায় এলে তাঁরা মহিলাদের মাসে দু’হাজার টাকা করে অর্থিক সহায়তা দেবেন। সে প্রকল্পের নাম হবে ‘অন্নপূর্ণার ভান্ডার’। এমনকি, আগামী লোকসভা ভোটে জিতে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফিরলে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই এই প্রকল্প চালুর সিদ্ধান্ত হবে বলেও ইতিমধ্যে দাবি করেছেন শুভেন্দু।
বিরোধী দলনেতা যখন এমন দাবি করছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন পঞ্চায়েতের প্রচারেই ঘোষণা করেছেন, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের প্রাপকেরা ৬০ বছর হয়ে গেলে এক হাজার টাকা করে পাবেন।’’ এখন দেওয়া হয় মাসে ৫০০ টাকা। কোমর ও পায়ের ব্যথার জন্য সশরীরে আর প্রচারে বেরোচ্ছে না মুখ্যমন্ত্রী। আউশগ্রামের গোপীনাথপুরে এ দিন বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের মোবাইল মারফত বক্তৃতা করেছেন তিনি। সেখানেই ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ নিয়ে ঘোষণা করার পাশাপাশিই মমতা বলেছেন, ‘‘আমি চাই, মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়াক। মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবেন না। আপনারা আমদের পরিবার।’’
তৃণমূলের নেতাদের একাংশ পঞ্চায়েতের প্রচারে ইতিউতি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তাঁদের দল হেরে গেলে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ বন্ধ হয়ে যাবে। তার জবাবে বিজেপি নেতারা আবার টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন! আরও এক ধাপ এগিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুরের সুখদেবপুরে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এ দিন বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ভয় পেয়েছেন। বলছেন, আমরা হেরে গেলে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ কে দেবে? আপনারা এক দম ভাববেন না। কারও যদি ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ বন্ধ হয়, আমাকে জানাবেন। আমি হাই কোর্টে গিয়ে লড়ে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ আনিয়ে দেব’!
কিন্তু তাঁরাই তো ‘খয়রাতির রাজনীতি’র ঘোরতর সমালোচক ছিলেন! বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ ছিলেন এই বিষয়ে সব চেয়ে মুখর। যিনি বলতেন, বাংলার মানুষকে ‘ভিক্ষের বাটি’ হাতে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে তৃণমূল। সেই দিলীপের ব্যাখ্যা, ‘‘আমাদের দলের কোনও ঘোষণাপত্রে টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়নি। পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতলেও তো টাকা দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা করা যাবে না। তা হলে এমন প্রতিশ্রুতি দেব কেন? বিজেপি নীতিগত ভাবে মানুষের জীবনের মানোন্নয়নে বিশ্বাসী।’’ কিন্তু বিজেপি নেতারা তো বলছেন আরও বেশি করে মহিলাদের সহায়তা দেওয়ার কথা! এর প্রেক্ষিতে দিলীপের মন্তব্য, ‘‘কোনও রাজ্যেই বিজেপি টাকা দেওয়ার কথা বলে না। কিন্তু এই রাজ্যের মানুষ যদি ৫০০ টাকা পেয়ে খুশি হয়, ভোট দেয়, যদি মনে হয় জীবনের সব সমস্যা মিটে যাবে, তা হলে আমরাও দেব! পাঁচশো কেন, দু’হাজার টাকা দেব!’’
এমতাবস্থায় বিজেপিকে বিঁধতে ছাড়ছেন না তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। নারায়ণগড়ে এ দিনই তাঁর মন্তব্য, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডার এখন ভগবানের প্রসাদ হয়ে গিয়েছে! প্রতিযোগিতা চলছে সুকান্ত মজুমদার আর শুভেন্দু অধিকারীর। কে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডারে’র নাম করে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে থাকতে পারে। ক্ষমতায় থাকা রাজ্যে বিজেপি যদি হাজার টাকার ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ চালু করতে পারে, আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব!’’
সমালোচনা করেছিল কংগ্রেসও। অথচ পঞ্চায়েতে তাদের ‘পঞ্চশীল’ ঘোষণাতেও মহিলাদের আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর দাবি আছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মতে, ‘‘আমরা এই রকম কোনও স্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে নই। কিন্তু মানুষ হাঁটতে না পারলে ক্রাচ লাগে। সেই ভাবেই মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলার লক্ষ্যে সাময়িক ভাবে আর্থিক সহায়তার কথা বলছে কংগ্রেস। কর্নাটকে কংগ্রেস সরকার সেটা করে দেখাচ্ছে।’’ তাঁরও বক্তব্য, পঞ্চায়েত হাতে পেলে এমন প্রকল্প নেওয়া যায় না। রাজ্যে সরকার গড়লে এমন ভাবনা আছে তাঁদের। অধীরের সংযোজন, ‘‘আবার বলছি, আমরা এটা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী নই। ভোট না পেলে ভান্ডার বন্ধ করে দেব বলার লোকও নই!’’