Firhad Hakim

Partha Chatterjee: পার্থ-অর্পিতার ‘ইচ্ছে’ বাড়ির অনিয়ম ও কর ফাঁকিতে ববির ‘অনিচ্ছে’ দেখছে বিরোধী শিবির

পার্থ বাড়িটি বানালেও পরে তা অর্পিতার নামে করে দেওয়া হয়। এখন মেয়র তদন্তের নির্দেশ দেওয়ায় বিরোধীদের প্রশ্ন, এত দিন কি প্রশাসন চোখ বুজে ছিল?

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২২ ২১:৩৮
Share:

‘ইচ্ছে’ বাড়ির অনিয়ম নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ায় ফিরহাদের কি অনিচ্ছে ছিল?

প্রথমে নগদ অর্থ উদ্ধার। পরে বিপুল সম্পত্তির খোঁজ। এই ভাবেই এগোচ্ছিল প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) তদন্ত। কিন্তু এখন প্রকাশ্যে এসেছে শুধু নামে-বেনামে সম্পত্তিই নয়, আইনকে ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ। পার্থ গ্রেফতার হওয়ার পর রাজডাঙা এলাকার ‘ইচ্ছে’ বাড়িটি নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতার মেয়র, কেএমডিএ চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ। সেই সূত্রেই বিরোধীদের প্রশ্ন— এত দিন কেন ওই বাড়িটি নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেননি ফিরহাদ? পার্থ-অর্পিতা গ্রেফতার হওয়ার পর কেন তদন্তের নির্দেশ?

Advertisement

কলকাতা পুরসভার খাতায় যে জমি ফাঁকা প্লট হিসাবে পড়ে থাকার কথা, সেখানেই পার্থর নামে তৈরি হয়েছিল ‘ইচ্ছে’ নামের বাড়িটি। যা পরে অর্পিতার নামে হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, বাড়িটি বাণিজ্যিক কারণে ব্যবহার করা হলেও তার জন্য প্রদেয় কর মেটানো হয়নি। কিন্তু এতদিন এ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। এখন সব জানাজানি হতে তড়িঘড়ি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন ফিরহাদ। আর তার প্রেক্ষিতেই বিজেপি এবং সিপিএম প্রশ্ন তুলেছে— ‘ইচ্ছে’ বাড়ির অনিয়ম নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ায় ফিরহাদের কি অনিচ্ছে ছিল?

‘ইচ্ছে’ বাড়িটি নিয়ে ফিরহাদ তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পরেই তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। শনিবার তিনি বলেন, ‘‘এখন এটাও তদন্ত হওয়া দরকার যে, নিয়ম ভেঙে বাড়ি বানানো এবং কম কর দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ফিরহাদ সাহেব বা তাঁর দলের পকেটে কত টাকা ঢুকেছে! পুরসভা বা কেএমডিএ-র কোনও কর্তাও এর পিছনে রয়েছেন কি না, তারও তদন্ত হওয়া দরকার। আমার মনে হয় সব জেনেশুনে ইচ্ছে করেই সতীর্থ পার্থের ‘ইচ্ছে’ বাড়িকে নিয়ম ভাঙার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’’

Advertisement

সুকান্তের আরও দাবি, ওই বাড়িটি যেহেতু এখন ইডির কব্জায়, তাই কলকাতা পুরসভা বা কেএমডিএ কিছুই করতে পারবে না। কেঁচো খুড়তে গিয়ে কেউটে বার হতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন সুকান্ত। সেই সঙ্গেই তিনি বলেন, ‘‘সবেতেই কেন্দ্রের আর বিজেপির চক্রান্ত দেখে তৃণমূল। এখন তো দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, দলের মহাসচিব, রাজ্যের মন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর ডানহাতই এত সব কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছেন। বিজেপি তো ওঁকে দিয়ে এগুলো করায়নি!’’

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত থেকে পুরসভা, পুলিশ থেকে সরকার— সকলেরই তো একটা নজরদারির ব্যবস্থা রয়েছে। তারা সকলেই কি ঘুমিয়েছিল এত দিন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, তিনি সব কিছুতেই নজর রাখেন। তবে এটা তাঁর নজরে রইল না কেন?’’ সেই সূত্রেই সেলিমের দাবি, ‘‘এ রাজ্যে পুরসভা থেকে পুলিশ-প্রশাসন সবই হয়ে গিয়েছে দুর্নীতির ক্রীড়নক। সাধারণ মানুষ একটা জানলা লাগানোর অনুমতি পায় না আর প্রভাবশালীদের জন্য সবেতেই ছাড়!’’

ইডি সূত্রে জানা গিয়েছে, কসবার রাজডাঙা এলাকায় একটি প্রোডাকশন হাউস চালাতেন ‘পার্থ-ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা। সেই সূত্রেরই বক্তব্য, শ্যুটিংয়ের জন্য ভাড়া দেওয়ার পাশাপাশি সেখানে একটি প্রোডাকশন হাউসের কাজও চলত। আবার জুনিয়র অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হত।

২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে ২০১৩ সাল নাগাদ অর্পিতা ওই প্রোডাকশন হাউসটি খোলেন বলে দাবি ইডির। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, প্রথমে জমি এবং বাড়ি ছিল পার্থের নামেই। ২০১৪ সালে নাম বদলে অর্পিতাকে মালিক করা হয়।তবে এই জমির মালিক কলকাতা পুরসভা নয়, ‘কলকাতা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ (কেএমডিএ)। কিন্তু বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, কলকাতার মেয়র ফিরহাদ এমন বেনিয়মের কথা আগে থেকে জানতেন না বলে দায় এড়াতে পারেন না। কারণ, কেএমডিএ-র চেয়ারম্যান পদেও রয়েছেন ফিরহাদ। আর বিতর্ক শুধু একটি প্লট নিয়ে নয়। তিনটি প্লট নিয়ে। ১১ নম্বর প্লটে ‘ইচ্ছে’ বাড়িটি ২ কাঠা ৯ ছটাক জমির উপর তৈরি। তার দু’পাশে ১০ এবং ১২ নম্বর প্লট নিয়েও অভিযোগ উঠেছে। কারণ, ওই দু’টি প্লটে বাড়ি থাকলেও পুরসভার খাতায় নাকি তা ‘খালি জমি’ হিসাবেই উল্লিখিত রয়েছে।

তবে আপাতত বেশি নজর ১১ নম্বর প্লটের দিকে। যেখানে ‘ইচ্ছে’ বাড়িটি পার্থ হয়ে অর্পিতার মালিকানায় এসেছে। কেএমডিএ-এর এক কর্তা জানিয়েছেন, এই বাড়িটির জন্য কর দেওয়া হয় বছরে মাত্র ২,৩৫৬ টাকা। যেখানে পাওয়ার কথা ১ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকার বেশি। ফিরহাদের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা হলেও কলকাতার মেয়রের কোনও জবাব পাওয়া যায়নি। ফোন করা হলেও যোগাযোগ করা যায়নি। তবে কেএমডিএ-র এক আধিকারিক বলেন, ‘‘অনেক বাড়ি রয়েছে। আমাদের এলাকাও অনেক বড়। সব সময়ে সব কিছুতে নজর দেওয়া যায় না। নজর এড়িয়ে যায় অনেক সময়। কিন্তু এটা কেউ বলতে পারবে না যে, নির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রেও অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মাননীয় চেয়ারম্যান প্রয়োজনীয় তদন্তের নির্দেশে দিয়েছেন।’’

৯৫ নম্বর রাজডাঙ্গা মেন রোডের ঠিকানায় অর্পিতার ‘ইচ্ছে’ নামের বাড়িটি রয়েছে। কিন্তু বাড়িটি আদতে পার্থের নামেই ছিল। সূত্রের খবর, ২০১৩ সালে অর্পিতা সেখানেই প্রথম নিজের প্রযোজনা সংস্থার দফতর খুলে বসেন। ২০১১ সালে বাড়িটি তৈরি হয়। পার্থের মালিকানাধীন বাড়িটি ২০১৪ সালে অর্পিতার নামে করে দেওয়া হয়। কলকাতা পুরসভার কর রাজস্ব খাতার তালিকা অনুযায়ী রাজডাঙার ওই ঠিকানায় ১০, ১১ এবং ১২ তিনটি প্লট আছে। ১১ নম্বর প্লটে ‘ইচ্ছে’ নামে বাড়িটি রয়েছে বলে পুরসভার খাতায় উল্লেখ রয়েছে। বাকি ১০ এবং ১২ নম্বর প্লটে বাড়ি থাকলেও পুরসভার খাতায় তা দেখানো রয়েছে ‘ফাঁকা জমি’ হিসেবে। ১১ নম্বর প্লট, যেখানে বাড়িটি দু’কাঠা নয় ছটাকের উপর তৈরি, তার জন্য পুরসভাকে বার্ষিক কর দেওয়া হত ২,৩৫৬ টাকা। অথচ ওই এলাকায় পুরসভার কর পাওয়ার কথা বার্ষিক ১ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকারও বেশি। বিরোধীদের প্রশ্ন— কলকাতা পুরসভা এলাকায় দিনের পর দিন এত বড় বাড়ি তৈরি করে সেখানে প্রযোজন সংস্থার দফতর চালানো হল, শ্যুটিংয়ের জন্য এবং বিয়ের জন্য বাড়ি ভাড়া দেওয়া হল। অথচ কলকাতা পুরসভার কর্তারা কিছুই জানলেন না?

ওই প্লটগুলি কলকাতা মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (কেএমডিএ) অধীনে হওয়ায় অভিযোগ ওঠার পর এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন ফিরহাদ। এত দিন কেন তদন্ত হয়নি? মেয়র কোনও মন্তব্য করতে না চাইলেও কেএমডিএর একটি সূত্রের দাবি, এত দিন ওই প্লট সংক্রান্ত নিয়ে কোনও সঠিক তথ্যই ছিল না কলকাতা পুরসভা ও কেএমডিএ-র কাছে। পার্থ-অর্পিতার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরেই ‘ইচ্ছে’ বাড়িটি নজরে আসে তাঁদের।

এই ধরনের বেনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিরোধীরা। তাই অভিযোগ পাওয়ার পরেই ‘ইচ্ছে’ বাড়িটির নির্মাণ কী ভাবে হল এবং সেখানে কী ভাবে কেএমডিএ এবং কলকাতা পুরসভার নজর এড়িয়ে কাজ হত, তা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে কেএমডিএ। কিন্তু এত বড় আর্থিক বেনিয়ম হওয়ার পরেও এ বিষয়ে তদন্ত করতে এত বিলম্ব হল কেন? জবাবে আধিকারিকদের সাফাই, নির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পরেই তাঁরা তদন্ত শুরু করেছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement